• সর্বশেষ আপডেট

    চমেক সংঘর্ষ, মূল কারণ আধিপত্য নাকি বানিজ্য?

      


    দীর্ঘদিন শান্ত থাকার পর আবার উত্তপ্ত চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক)। গত বছরের ১২ জুলাই স্লোগান দেওয়াকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষের পর গত এক বছরে পাঁচবার ক্যাম্পাসে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়েছেন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। সর্বশেষ গত ২৯ অক্টোবর রাতে দুই পক্ষ সংঘর্ষে জড়ায়। এই ঘটনার জেরে পরদিন মাহাদি জে আকিব নামের এক শিক্ষার্থীকে বেধড়ক পিটিয়ে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছেন প্রতিপক্ষের নেতাকর্মীরা। ওই শিক্ষার্থী মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন।

    আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এসব সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে বলা হলেও খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ঘটনার পেছনে বিভিন্ন কারণ রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সংঘর্ষের নেপথ্যে রয়েছে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালকেন্দ্রিক টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, হাসপাতাল এলাকার বিভিন্ন দোকান থেকে চাঁদাবাজি, কমিশন বাণিজ্য, হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে দালাল ও অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ।

    দীর্ঘদিন ধরে মেডিক্যাল কলেজের নিয়ন্ত্রণ মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিনের অনুসারীদের হাতে। ২০০৮ সালে ছাত্র শিবিরকে ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করার পর এতদিন মেডিক্যাল কলেজ ক্যাম্পাসে তাদের একক নিয়ন্ত্রণে ছিল। ক্যাম্পাসে এই অংশের ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের একক আধিপত্য থাকায় তাদের ব্যবহার করে চট্টগ্রামের এক চিকিৎসক নেতা দীর্ঘদিন হাসপাতালে খাবার সরবরাহ থেকে শুরু করে টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, বদলি, কমিশন বাণিজ্য চালিয়ে আসছেন। 

    সম্প্রতি মেডিক্যাল কলেজে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দেন শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের অনুসারীরা। ২০২০ সালের ১৩ আগস্ট স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে মহিবুল হাসান চৌধুরীকে হাসপাতালের পরিচালনা কমিটির সভাপতি মনোনীত করার পর ক্যাম্পাসে

    আধিপত্য বিস্তার করতে চাইছেন ছাত্রলীগের এই অংশের নেতাকর্মীরা। 

    অপরদিকে, নিজেদের নিয়ন্ত্রণে থাকা মেডিক্যাল কলেজ ক্যাম্পাসে অন্যদের আধিপত্য দেখতে চান না আ জ ম নাছির উদ্দিনের অনুসারীরা। যে কারণে দুই পক্ষের মধ্যে কয়েকদিন পরপরই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। একপক্ষ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ক্যাম্পাসে আধিপত্য ধরে রাখতে অন্যদের মারধর করছে; অপরপক্ষ যেকোনও মূল্যে আধিপত্য বিস্তার করতে চাইছে।

    ২০২০ সালের ১২ জুলাই ক্যাম্পাসে স্লোগান দেওয়াকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষ প্রথম দফায় সংঘর্ষে জড়ায়। ওই দিন সকালে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী হাসপাতাল পরিদর্শনে যান। পরিদর্শন শেষে ক্যাম্পাস ত্যাগ করার পরপরই স্লোগান দেওয়াকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষ সংঘর্ষে জড়ায়। এরপর গত ২ মার্চ ছাত্রাবাসে সিট দখলকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দুই পক্ষ আবার সংঘর্ষে জড়ায়। তৃতীয় দফায় গত ২৭ এপ্রিল চমেক ক্যানটিনে এক ছাত্রলীগ নেতাকে কটূক্তি করার ঘটনার জেরে দুই পক্ষ আবার সংঘর্ষে জড়ায়।

    এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান নওফেলের অনুসারী হিসেবে পরিচিত ইন্টার্ন চিকিৎসক ইমন শিকদার  বলেন, ‘আগে মেডিক্যাল কলেজে যারা ছাত্রলীগের রাজনীতি করতেন তারা মহানগর আওয়ামী লীগের নেতাদের অনুসারী ছিলেন। তাদের ব্যবহার করে একজন চিকিৎসক নেতা টেন্ডারবাজিসহ হাসপাতালকেন্দ্রিক বিভিন্ন বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন। আমরা যখন নওফেল ভাইয়ের রাজনীতি শুরু করেছি, তখন তারা ভাবছে আমাদের কারণে তাদের বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাবে। এ কারণে বারবার তারা নানা অজুহাতে আমাদের সঙ্গে মারামারি করছে। আমাদের নানাভাবে বিপদে ফেলার চেষ্টা করছে।

    প্রশাসন ওই পক্ষকে সাপোর্ট করছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, প্রথম দফায় যখন মারামারি ঘটনা ঘটে তখন যদি প্রশাসন নিরপেক্ষ থেকে যথাযথ পদক্ষেপ নিতো তাহলে আজ আকিবকে এই ধরনের পরিণতি ভোগ করতে হতো না। কলেজের অধ্যক্ষসহ একাডেমিক কাউন্সিল আমাদের গার্ডিয়ান। কিন্তু তারা অভিভাবকসুলভ আচরণ করতে পুরোপুরি ব্যর্থ। এ জন্য বারবার সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে।

    এ বিষয়ে জানতে আ জ ম নাছির উদ্দিনের অনুসারী কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি এম এ আউয়াল রাফিকে একাধিকবার কল দিলেও রিসিভ করেননি। এসএমএস দিলেও রিপ্লে দেননি। পরে একই ছাত্র সংসদের জিএস প্রীতম কুমার শাহকে কল দিলেও রিসিভ করেননি।

    জানতে চাইলে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিন বলেন, আমি ছাত্রলীগের এসব ঘটনার বিষয়ে বক্তব্য দিতে চাচ্ছি না। আমি আওয়ামী লীগ করি, আপনি আওয়ামী লীগ সম্পর্কে কিছু জানতে চাইলে বলতে পারি।

    একই ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, তিনি বলেন, মেডিক্যালে আমার কোনও রাজনীতি করার ইচ্ছা নেই। মেডিক্যাল কলেজে কোনও ঘটনা ঘটলে তারা একটা রাজনৈতিক ব্যানার দাঁড় করায়। আমি মেডিক্যাল কলেজের সঙ্গে কোনোভাবে জড়িত নই। হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা কমিটিতে আছি, হাসপাতালের উন্নয়নে নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করার চেষ্টা করছি।

    তিনি আরও বলেন, আমি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সঙ্গে কথা বলেছি, তারা জানিয়েছে চমেকে ছাত্রলীগের কমিটি নেই। মহানগর ছাত্রলীগও সেখানে কমিটি দেয়নি। যারা চমেকে নিজেদের ছাত্রলীগ হিসেবে পরিচয় দিচ্ছে, তারা আদৌ ছাত্রলীগ কিনা খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে। আমার নাম বলে কেউ যদি সেখানে কোনও ক্রাইম করে আমি পুলিশ কমিশনারকে বলেছি, ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্য। প্রিন্সিপালকে বলেছি, কেউ যদি আমার নামে সেখানে কোনও ব্যানার দেয়, তাহলে সেটি যেন কেটে ফেলেন। আমার নামে কেউ যদি একাডেমিক কর্মকাণ্ডে বাধা সৃষ্টি করে তাদের বিরুদ্ধে যেন যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। মেডিক্যাল কলেজে এতদিন কে কি করেছে আপনারা জানেন। এসব অনিয়ম বন্ধ না করলে এ ধরনের সমস্যা চলতেই থাকবে।

    এ ব্যাপারে কলেজের অধ্যক্ষ ডা. শাহেনা আক্তার  বলেন, করোনার কারণে অনেকদিন কলেজ বন্ধ ছিল। গত ১৩ সেপ্টেম্বর কলেজ খুলে দেওয়া হয়েছে। এরপরই দুই পক্ষ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে দুই পক্ষ মারামারিতে জড়িয়ে পড়ে। বিষয়টি জানতে পেরে আমরা দুই পক্ষের সঙ্গে বসে মীমাংসার উদ্যোগ নিয়েছিলাম। কিন্তু পরদিন সকালে তারা আবার ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া শুরু করে। এ সময় আকিব নামের এক ছাত্র গুরুতর আহত হয়। এ অবস্থায় আমরা বৈঠক করে দ্রুত কলেজ বন্ধ ঘোষণা করি। এর আগেও আমরা একাধিকবার কলেজে সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছি। কিন্তু তারপরও ছাত্রদের দুটি পক্ষ বারবার মারামারিতে জড়িয়ে পড়ছে। সর্বশেষ ঘটনায় আমরা পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। তাদের প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে আমরা জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।

    তিনি আরও বলেন, ঘটনাগুলো একটার সঙ্গে অন্যটার মিল নেই। যদি একই ইস্যুকে কেন্দ্র করে হতো তাহলে একাডেমিক শাস্তি দিতে পারতাম। কিন্তু অধিকাংশ ঘটনা কথা কাটাকাটিকে কেন্দ্র করে হচ্ছে। এবারের মতো এ ধরনের ঘটনা আগে ঘটেনি। এবার জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।

    প্রকাশিত: মঙ্গলবার ০২ সেপ্টেম্বর ২০২১