• সদ্যপ্রাপ্ত সংবাদ

    মেয়ের বিয়ে, অপারেশনের টাকা ছাই: আহাজারিই সম্বল সোহাগী-সুগন্ধাদের

     


    আগুনের খবরে ছুটে এসে দেখেন কিছুই বাকি নেই। পোড়া ঘরের কাঠামোর সামনে দাঁড়িয়ে তাদের ছিল শুধু আহাজারি, হতাশা আর সহায় সম্বল হারানোর বেদনা।

    আগুনে পুড়ে যাওয়া ঘরের ওপর দাঁড়িয়ে কান্না করছিলেন সোহাগী দাশ। মাঝ বয়সী এই নারীর কাছে যেতে বললেন, “ছোট মেয়ের বিয়ের কথা চলছে। সব ঠিক থাকলে বৈশাখেই বিয়ে। খেয়ে না খেয়ে টাকা জমিয়ে মেয়ের বিয়ের জন্য ৬২ হাজার টাকা রেখেছিলাম। সাথে এক ভরি অলঙ্কারও বাসায় ছিল। আগুনে আমার সব শেষ।” 

    দিনের পর দিনে কষ্ট করে জমানো এসব টাকার জন্য আক্ষেপ ঝরছে তার কণ্ঠে। বলছেন, “এ টাকায় তো বিয়ের অনুষ্ঠান হবে না, লোকজনের কাছ থেকে সহায়তা নিয়ে বিয়ে দিতাম। কিন্তু আমার তো সহায় সম্বল সব চলে গেল।” 

    টাকা, অলঙ্কারের সঙ্গে ঘরে নতুন কাপড়ও ছিল। ছোট মেয়ের বিয়েতে কিছুদিন আগে বিয়ে হওয়া বড় মেয়ের জামাই খেতে পারবে না বলে রোববার জামাইভাতা করেছিলেন। কান্নার সুরে ঘরে থাকা কী কী পুড়েছে সেই তথ্য দিয়ে তিনি বলেন, “কালই তো মেয়ের বাড়ির আত্মীয়-স্বজন এসেছিল। আমার তো আজকে সব শেষ। কীভাবে আমি মেয়ের বিয়ে দিব?” 

    চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে ‘সেবিকা বন্ধুর’ কাজ করেন সোহাগী। আগুন লাগার সময় ডিউটি ছিল আগ্রাবাদে। খবর পেয়ে দ্রুতই চলে আসেন। ঘটনার সময়কার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, “আমার স্বামীও ঘরে ছিল না। ঘরে ছিল শুধু ছোট মেয়ে। আগুন দেখে মেয়ে দ্রুত বের হয়ে যায়। এত দ্রতই আগুন ছড়িয়েছে কিছুই বের করা যায়নি।”

    সোহাগীর মতো আরেক মা সুগন্ধা হারিয়েছেন তার মেয়ের টিউমার অপারেশনের জন্য জমানো ৫০ হাজার টাকা। 

    তাদের আরেক প্রতিবেশী বিরজিৎ দাশও মেয়ের বিয়ের জন্য টাকা জমিয়েছিলেন। নিজের ও শ্যালকের ঘরে রাখা জমানো সেই টাকা পুড়েছে। চাবিটাই রয়েছে শুধু তার হাতে, আগুনের তাপে গলে গেছে স্টিলের আলমারি। দুই ঘরের সব পুড়ে যাওয়ায় এখন নিঃস্ব মাছের ট্রলারের এই চালক। 

    শুধু এ দুইজন নয়, সোমবার দুপুরে লাগা আগুনে চোখের সামনেই একে একে ঘর পুড়তে দেখেছেন দুই বস্তির শতাধিক পরিবার; এক লহমার আগুনে হয়ে পড়েছেন নিঃস্ব। 

    চোখের সামনে মাথা গোঁজার ঠাঁই ছোট ঘর ও সহায় সম্বল যখন পুড়ে যাচ্ছিল এ দুই বস্তির বাসিন্দাদের তখন কিছুই করার ছিল না। আগুন নেভানোর পর ছিল শুধু তাদের আহাজারি, হতাশা আর সহায় সম্বল হারানোর বেদনা। 

    চট্টগ্রামের ফিরিঙ্গি বাজারের টেকপাড়া বস্তি ও লাগোয়া এয়াকুব নগর বস্তিতে সোমবার দুপুরে আগুন লেগে

    নগরীর ফিরিঙ্গি বাজার মেরিনার্স রোডের সঙ্গে লাগোয়া টেকপাড়া বস্তি ও এয়াকুব নগর লইট্টা ঘাটা বস্তিতে লাগে এ আগুন। টেকপাড়া বস্তিতে জেলে সম্প্রদায়ের শতাধিক পরিবারের বসবাস। জেলে সম্প্রদায় হলেও তাদের অনেকেই আবার বিভিন্ন পেশায় আছেন। 

    এর লাগোয়া এয়াকুব নগর লইট্টা ঘাটা বস্তিতে বেশির ভাগই নিম্ন আয়ের বিভিন্ন পেশার লোকজনের বসবাস। 

    ফায়ার সার্ভিসের চট্টগ্রাম অঞ্চলের উপ-সহকারী পরিচালক (ডিএডি) আব্দুর রাজ্জাক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সোমবার বেলা ১টা ২০ মিনিটে ওই বস্তিতে আগুন লাগে। খবর পেয়ে ৯টি ইউনিটের প্রায় এক ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। 

    ফিরিঙ্গীবাজারের মেরিনার্স রোড সংলগ্ন টেকপাড়া বস্তিতে কীভাবে আগুনের সূত্রপাত হল, তা জানাতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস। আগুন লাগার পর দূর থেকেও কালো ধোঁয়া উড়তে দেখা যাচ্ছিল।

    বিকালে দুই বস্তিতে গিয়ে গিয়ে দেখা যায় সহায় সম্বল হারানো পরিবারগুলো সব হারানোর আহাজারি করছে। কীভাবে সবকিছু সামলে নেবে তা ভাবতেও পারছেন না তারা। 

    টেক পাড়া বস্তিতে কাঠ, টিন ও বেড়ার ঝুপড়ি ঘরগুলোর মধ্যে আছে চার তলার ছোট একটি ভবন। আগুন থেকে রক্ষা পায়নি সেটিও। 

    এটির নিচতলার একটি ঘরে থাকেন মাছ ধরার ছোট ট্রলারের চালক বিরজিৎ দাশ। তার ঘরের কাছেই টিন আর কাঠের তৈরি ঘরে ভাড়া থাকেন তার শ্যালক কমল দাশ। 

    বিরজিৎ বলেন, একই পাড়ার এক ছেলের সঙ্গে তার একমাত্র মেয়ের বিয়ের কথা পাকা হয়েছে। জ্যৈষ্ঠ মাসে মেয়ের বিয়ে। বিয়ের বাজার সদাই করার জন্য টাকা রেখেছিলেন ঘরে। আগুনে পুড়ে সব শেষ। 

    হাতে স্টিলের আলমারির চাবি নিয়ে আহাজারি করতে করতে বিরজিৎ বলেন, “আমার ঘরে রেখেছিলাম প্রায় তিন লাখ আর শ্যালকের ঘরের স্টিলের আলমারিতে রাখা ছিল দুই লাখ টাকা। আগুনে পুড়ে সব শেষ। 

    “আলমারিটি পুড়ে গলে গেছে। হাতে চাবি থাকলেও আলমারির ভেতরে কিছুই নাই। আমার ঘরের আলমারিও পুড়ে গেছে। টাকা গেল সব গেল… আমরা এখন নিঃস্ব।” 

    অভাবের সংসারে ছোট্ট দুই মেয়ের ভবিষ্যতের জন্য খেয়ে না খেয়ে টাকা জমিয়ে রেখেছিল শিল্পী দাশ। আগুনে পুড়েছে তার সব। মেয়ের বিয়ের জন্য শিল্পীর বাসায় টাকা রেখেছিলেন তাদের নিকটাত্মীয় বিরজিৎ দাশ। নিজের ঘরের সঙ্গে পুড়েছে স্বজনের ঘরও।

    বিরজিতের শ্যালকের স্ত্রী শিল্পী দাশ সিটি করপোরেশনে দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজ করেন। 

    শিল্পী বলেন, “যা রোজগার করি, নিজে না খেয়ে সঞ্চয় করি। অনেক কষ্ট করে টাকা জমিয়ে রেখেছিলাম। গতকালে পরবে (নববর্ষের উৎসব) আমার ছোট দুই মেয়ে তাদের জামা কিনে দিতে বলেছিল, তাদের কিছু দিই নাই। টাকা জমানোর জন্য। আমার তো সব শেষ, এক কাপড় ছাড়া আর কিছুই তো নাই।” 

    বিকালে টেকপাড়ার আগুনে অন্য ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে কথা বলার সময় দেখা যায় তাদের মালামাল সরাতে সহায়তা করছেন নয়ন দাশ নামে এক যুবকসহ কয়েকজন। 

    নয়ন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ফিশারিঘাটে কাজ শেষে দুপুরে কয়েকজন মিলে লোকনাথ মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে গল্প করছিলেন। এ সময় বাতাস হচ্ছিল। হঠাৎ টেকপাড়ার গেইটের সঙ্গে লাগোয়া একটি নারকেল গাছের পাতায় আগুন দেখতে পান। 

    ”আগুন বাতাসে পাশের কাঠের তৈরি দুইতলার ঘরের জানালা দিয়ে ঢুকেছে। এসময় ইলেক্ট্রিক পুলের তারে স্পার্ক করছিল। হঠাৎ আগুন লেগে যায়। আমরা পানি দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করি। কিন্তু তা ছড়িয়ে যেতে থাকে।” 

    নয়নের সঙ্গে ওই সময় সেখানে থাকা রিকশাচালক নয়ন মিয়া বলেন, আগুন বেড়ে যাওয়ায় তিনি ৯৯৯ এ ফোন করেছিলেন আগুনের খবর দিতে। 

    “আমি যখন টেলিফোনে কথা বলছিলাম ওই সময় বাতাস হচ্ছিল। মুহূর্তের মধ্যেই আগুন পশ্চিম দিকে ছড়িয়ে এয়াকুব নগর লইট্টাঘাটা পাড়ায়ও ছড়িয়ে পড়ে।” 

    বাতাসের কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে যাওয়ায় টেকপাড়া ও লাইট্টাঘাটা বস্তির বেশির ভাগ ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে মনে করেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। 

    মেরিনার্স রোডের টেক পাড়ার পকেট গেইটের সঙ্গে লাগোয়া কাঠের ঘরটি সুগন্ধা দাশের। ওই ঘরের একটিতে ভাড়া থাকতেন কমল-শিল্পী দম্পতি। আরেকটি ঘরে এক ছেলে-এক মেয়েকে নিয়ে থাকতেন সুগন্ধা।

    আগুনে পুড়ে গেছে সুগন্ধা দাশের ঘর। অসুস্থ মেয়ের চিকিৎসা ও অপারেশনের জন্য ঘরে রাখা জমানো টাকাও পুড়ে গেছে। সব হারিয়ে পাগলপ্রায় তিনি।  

    সুগন্ধা বলেন, তিনি বন্দর হাসপাতালে ঠিকাদারের অধীনে আউট সোর্সিংয়ের ভিত্তিতে কাজ করেন। আগে তার স্বামী বন্দর হাসপাতালে কাজ করতেন। স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি এখন সেখানে কাজ নিয়েছেন। 

    “আমার মেয়ে অসুস্থ। গত ১৪ দিন ধরে মেয়ে বন্দর হাসপাতালে ভর্তি। পেটের টিউমার হওয়ায় আজকে বিকালে তাকে বাইরে ডাক্তার দেখানোর কথা ছিল। দুপুরে ঘরে আগুন লাগার খবর পেয়ে মেয়েকে নিয়ে এসে দেখি সব শেষ।”

    পাশে থাকা মেয়ের হাতে লাগানো ক্যানুলা দেখিয়ে সুগন্ধা বলেন, “মেয়ের অপারেশনের জন্য ৫০ হাজার টাকা রেখেছিলাম। টাকা পয়সা সব গেল, সাথে আমার মেয়ের ডাক্তারের কাগজপত্রও সব ছিল ঘরে। আগুনে তো আমার সব শেষ করে দিছে।“ 

    লইট্টা ঘাটা বস্তির বাসিন্দা ষাট পেরুনো সাজেদা বেগম বলেন, যখন আগুন লেগেছে তখন তিনি ঘরে ঘুমিয়ে ছিলেন। আগুন আগুন শব্দে ঘুম থেকে উঠে বাইরে এসে দেখেন টেকপাড়ার দিক থেকে আগুন আসছে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সব শেষ হয়ে গেল।

    সেখানকার আরেক সিদ্দিকা বেগম ফিশারি ঘাটের পাশের সড়কে মাছ বিক্রি করেন। সকাল ৬টার দিকে সেখানে চলে যান। মাছ বিক্রি শেষে বাসায় ফেরেন। 

    “ফিশারী ঘাটে আমাকে একজন বলছিল আমারা বাসার দিকে আগুন লেগেছে। আমি তার কথা বিশ্বাস করি নাই। পরে এখান থেকে ফোন করার পর দৌঁড়ে এসে দেখি আমার ঘর পুড়ে যাচ্ছে। ঘর থেকে কোন কাপড়চোপড় বের করতে পারি নাই। শুধু হাতের সামনে দুইটা বটি পেয়েছি। সেগুলো ছাড়া কোনো কিছুই আর বের করতে পারিনি।” 

    লইট্টাঘাটা বস্তির বাসিন্দাদের নারীরা কেউ বাসা বাড়িতে, কেউ পোশাক কারখানায় কাজ করেন। কেউ কেউ ফিশারি ঘাটে রাস্তার ধারে মাছ বিক্রি করেন। তাদের অনেকেই বলেন, “কয়েকদিন আগে ঈদ গেছে। সবার ঘরে কম বেশি নতুন জামা কাপড়, মালামাল। অনেকের কাছে ঈদের টাকাও ছিল। আগুনে সব শেষ হয়ে গেছে।”

    প্রকাশিত। সোমবার ১৫ এপ্রিল ২০২৪