• সর্বশেষ আপডেট

    তাঁত বোর্ডে দুর্নীতি পুরোনো মেশিনকে নতুন দেখিয়ে কিনেছে তাঁত বোর্ড!

      

     কুষ্টিয়ার কুমারখালিতে তাঁত বোর্ডের সার্ভিস সেন্টার। সেন্টারের খোলা জায়গায় রাখা হয়েছে মূল্যবান যন্ত্রপাতিদেশের তাঁতিদের জন্য নির্মিত দুটি সার্ভিস সেন্টারে ৫৮ কোটি ২৭ লাখ টাকার যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।

     সার্ভিস সেন্টারের জন্য অন্তত ২১টি পুরোনো যন্ত্রপাতিকে নতুন বলে কেনা হয়েছে। একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এবং তাঁত বোর্ডের সাবেক ও বর্তমান ছয়-সাত জন কর্মকর্তার যোগসাজশে পুরো প্রকল্পে বিভিন্ন অনিয়ম হয়েছে, যা একাধিক তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে।

     জানা গেছে, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনায় (আরডিপিপি) থাকা যন্ত্রপাতির স্পেসিফিকেশন বা বিবরণ পরিবর্তন করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ওয়ার্ক অর্ডার দিয়েছে তাঁত বোর্ডের একটি চিহ্নিত চক্র। এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত বোর্ডের কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়েছে। তবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তাঁত বোর্ড এখনও কোনও ব্যবস্থা নেয়নি।উপরন্তু, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সরবরাহ করা বিতর্কিত মেশিনারিজের বিল পরিশোধের জন্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে তাঁত বোর্ড। 

    এক বছর আগে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলেও সরকারি কোষাগারে অবশিষ্ট অর্থ জমা দেয়নি সংস্থাটি। এখনও তাদের নিজেদের অ্যাকাউন্টে মোটা অঙ্কের অর্থ জমা রাখার অভিযোগ আছে। এ সংক্রান্ত তথ্য-প্রমাণ ও দলিলাদির কপি আছে।২০২৩ সাল পর্যন্ত মেয়াদ বৃদ্ধির চেষ্টা গত ৯ বছর ধরে ঝুলে থাকা প্রকল্পটি এরইমধ্যে প্রায় মুখ থুবড়ে পড়েছে। যেসব যন্ত্রপাতি দুটি সার্ভিস সেন্টার এলাকায় নেওয়া হয়েছে তা বৃষ্টি ও রোদে অকেজো হওয়ার উপক্রম।

     এখন পর্যন্ত যন্ত্রপাতি ট্রায়ালেও যেতে পারেনি।পুরোনো মেশিন নতুন বলে সরবরাহঅনুসন্ধানে জানা গেছে, দেশের তাঁতি অধ্যুষিত এলাকায় তাঁত বোর্ডের ‘এস্টাবলিশমেন্ট অব থ্রি হ্যান্ডলুম সার্ভিস সেন্টারস ইন ডিফারেন্ট লুম ইনটেনসিভ এরিয়া (দ্বিতীয় সংশোধিত)’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর সার্ভিস সেন্টারের জন্য যন্ত্রপাতি সরবরাহ ও স্থাপন (লট ১) এবং কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালীর সার্ভিস সেন্টারের জন্য যন্ত্রপাতি সরবরাহ ও স্থাপনের (লট ২) জন্য যন্ত্রপাতি সরবরাহ, কেন্দ্রে প্রতিস্থাপন, প্রশিক্ষণ, ট্রায়াল প্রোডাকশন ইত্যাদি কাজের জন্য খুলনা শিপইয়ার্ড লিমিটেডকে (খুশিলি) ২০২০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি নোটিফিকেশন অব অ্যাওয়ার্ড (এনওএ) দেওয়া হয়। ওই বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি দুটি সার্ভিস সেন্টারে জন্য ৫৮ কোটি ২৭ লাখ টাকার বিভিন্ন যন্ত্রপাতি আমদানি ও সরবরাহের কাজ পায় তারা। এর আগে খুলনা শিপইয়ার্ডের সঙ্গে চুক্তি করে তাঁত বোর্ড। পরে খুলনা শিপইয়ার্ড লিমিটেড যন্ত্রপাতি সরবরাহের জন্য সহযোগী বা দ্বিতীয় আরেকটি পক্ষের সঙ্গে চুক্তি করে।সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের কার্যালয়জানা গেছে, প্রথমে নারায়ণগঞ্জের একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যন্ত্রপাতি বা মেশিনারিজ আমদানির সিদ্ধান্ত নেয় খুলনা শিপইয়ার্ড। 

    তবে নারায়ণগঞ্জের ওই প্রতিষ্ঠানটি যন্ত্রপাতি আমদানি করতে ব্যর্থ হয়। পরে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে খুলনা শিপইয়ার্ড সেই প্রতিষ্ঠান থেকে সরে আসে। এরপর খুলনা শিপইয়ার্ড ‘এ কে সোবহান ট্রেডার্স’ নামে ঢাকার বনানীর একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়। প্রতিষ্ঠানটি ২০২১ সালজুড়ে যন্ত্রপাতি আমদানি ও স্থাপন শুরু করে। খুলনা শিপইয়ার্ডকে অন্ধকারে রেখে একে সোবহান ট্রেডার্স তাঁত বোর্ডের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তার সঙ্গে যোগসাজশ করে অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে।জানা যায়, ২০২২ সালের ২৪ জুন এ কে সোবহান ট্রেডার্সের সরবরাহকৃত যন্ত্রপাতির মান, গ্রহণযোগ্যতা ও সেগুলো স্থাপনের অগ্রগতি যাচাইয়ের জন্য তাঁত বোর্ড বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে ছয় সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে দেয়। 


    কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন বাংলাদেশ তাঁত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যক্ষ ইঞ্জিনিয়ার মতিয়ার রহমান। কমিটির সদস্যরা হচ্ছেন—তিনটি হ্যান্ডলুম সার্ভিস সেন্টার স্থাপন শীর্ষক প্রকল্পের বর্তমান পরিচালক মোহাম্মাদ ইছা মিয়া, তাঁত বোর্ডের উপমহাব্যবস্থাপক (অপ.) মঞ্জুরুল ইসলাম, বিটিএমসি’র উপ-মহাব্যবস্থাপক (কারিগরি) কামরুল হাসান, বোর্ডের কারিগরি কর্মকর্তা আহসান উল্লাহ ও বস্ত্র অধিদফতরের সহকারী পরিচালক (কারিগরি) দেলোয়ার হোসেন।বিশেষজ্ঞ কমিটিযন্ত্রপাতির মান, গ্রহণযোগ্যতা ও স্থাপনের অগ্রগতি যাচাইয়ে গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটি গত ১৩ ফেব্রুয়ারি সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর সার্ভিস সেন্টার এবং ১৪ ফেব্রুয়ারি কুষ্টিয়ার কুমারখালীর সার্ভিস সেন্টার পরিদর্শন করে। তাদের সঙ্গে খুলনা শিপইয়ার্ডের প্রতিনিধি ও এ কে সোবহান ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী মঞ্জুরুল ইসলাম সুমন, সামিরুল আক্তার শাকিলসহ অন্যান্য প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন।কারিগরি এই কমিটি পরিদর্শন শেষে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডকে একটি প্রতিবেদন দেয়। ওই প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দুটি সার্ভিস সেন্টারে ‘এ কে সোবহান ট্রেডার্স’ ২৮ ধরনের ৩৫টি যন্ত্রপাতির মধ্যে তখন পর্যন্ত স্থাপন করেছে ৩৩ ধরনের যন্ত্রপাতি।প্রতিবেদনে বলা হয়, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘এ কে সোবহান ট্রেডার্স’-এর সরবরাহকৃত ভারী যন্ত্রের মধ্যে ২১টি নতুন বলে মনে হয়নি। তিনটি যন্ত্র আমদানির কাগজপত্র নেই। দুটি যন্ত্রের ক্যাটালগের সঙ্গে যন্ত্রের মিল নেই। ছয়টি মেশিন নতুন বলে মনে হয়েছে। দুটি যন্ত্র প্রকল্প এলাকায় পাওয়া যায়নি। অনেক যন্ত্রের স্পেসিফিকেশন বা গুণাবলি ওয়ার্ক অর্ডারের সঙ্গে মিল নেই।শাহজাদপুরে তাঁত বোর্ডের সার্ভিস সেন্টারএছাড়া তখন পর্যন্ত সার্ভিস সেন্টারের যন্ত্রের সঙ্গে ওয়াটার লাইন, স্টিম লাইন ও এয়ার কম্প্রেসার লাইন স্থাপন হয়নি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করে কমিটি। তাঁত বোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছে এই প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়।মতিয়ার রহমানের নেতৃত্বাধীন কমিটির এই প্রতিবেদন সম্পর্কে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিক মঞ্জুরুল ইসলাম সুমন বলেন, ‘মতিয়ার রহমান একজন অসাধু ব্যক্তি। তিনি টাকা চেয়েছিলেন, আমরা তাকে টাকা দেইনি। ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি এমন প্রতিবেদন দিয়েছেন। আমাদের কাছে সব ধরনের কাগজপত্র আছে। কিন্তু তারা কোনও কাগজপত্র দেখেননি। আমরা তাঁত বোর্ডের চেয়ারম্যানের সঙ্গেও বসতে চেয়েছি।

     কিন্তু তারা কেউ আমাদের কথা শোনেন না। আমাদের কাছে যেহেতু প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আছে, যখন যেখানে যেতে বলবে, আমরা সেখানে যেতে রাজি আছি।’তিনি বলেন, ‘আমাদের মেশিনগুলো দীর্ঘদিন বাইরে (খোলা জায়গায়) পড়ে ছিল। পলিথিন দিয়ে আমি বেঁধে রেখেছি। কতবার আমি পলিথিন পরিবর্তন করবো? তাঁত বোর্ডকে বলছি, আপনারা ভবন খালি করে দেন, মেশিন ভেতরে রাখি। তারা তা করেনি। তাই মেশিন পুরোনো দেখাচ্ছে।’ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছে ঘুষ চাওয়ার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির প্রধান ইঞ্জিনিয়ার মতিয়ার রহমানের বলেন, ‘আমার বাপের অনেক টাকা আছে। আমি এমন না।

     আমাদের কাছে যেসব মেশিন নতুন বলে মনে হয়নি, আমরা সেটাই প্রতিবেদনে লিখেছি। আমরা সরাসরি পুরোনো- এই শব্দটা লিখিনি। লিখেছি, নতুন বলে প্রতীয়মান হয়নি। তাদের যদি কাগজপত্র থাকে, তাহলে তাঁত বোর্ডেকে তারা দেখাবে।’ তিনি বলেন, ‘আমি এক বছর আগে অবসরে চলে এসেছি। এখন এসব বিষয়ে আমি জানি না।’শাহজাদপুরে সার্ভিস সেন্টারের বাইরে অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে মূল্যবান যন্ত্রপাতিপ্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ ইছা মিয়া বলেন, ‘আমি প্রকল্পের দায়িত্ব পাওয়ার আগেই এর ওয়ার্ক অর্ডার হয়ে যায়। আমি আসার পর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেশিনগুলো সরবরাহ শুরু করে। ওয়ার্ক অর্ডারের বিষয়ে আমি  জানি না।’এসব অনিয়মের বিষয়ে তাঁত বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিমের বক্তব্য জানতে তিন দিন তার অফিসে গেলেও তিনি সাক্ষাৎ দেননি। এরপর তার মোবাইল ফোনে এ বিষয়ে এসএমএস পাঠানো হলেও উত্তর দেননি এবং একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।

    সূত্রঃ বাংলাট্রিবিউন। 

    প্রকাশিত বৃহস্পতিবার ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২