• সর্বশেষ আপডেট

    বাম্পার ফলনেও ন্যায্য দাম না আসায় হতাস চাষীরা: অভিযোগ মৌসুমি সিন্ডিকেটের দিকে

     

    কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার উপকূলীয় 
    অঞ্চলে লবণ চাষের ভরা মৌসুম,পুরোদমে চলছে মাঠে লবণ উৎপাদন। চরম গরমের তাপ উপেক্ষা করে মাঠে কাজ করছেন চাষীরা। লবণ কে এই জনপদের চাষীরা সাদা সোনা বলে দাবি করে থাকেন,আর এই সাদা সোনাকে ঘিরেই চাষীরা সফলতার স্বপ্ন দেখেন প্রতি মৌসুমে। 

    প্রতিবারের ন্যায় এবারেও হাজারো শ্রমে ঘামে একাকার হয়ে লবণ চাষে কাঙ্খিত ফসল পেয়েও
    ন্যায্য মূল্য না পেয়ে সফলতার স্বপ্ন ভেঙ্গে তছনছ হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন নিরুপায় লবণ চাষীরা। অভিযোগ করে বলেন লবণ মিলের মালিক ও অসাধু কিছু মৌসুমি ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে মাঠ পর্যায়ে লবণের দাম কমিয়ে দিয়েছে, যার কারণে এতো কষ্ট করে লবণ চাষ করেও ঠিকই দুঃখ ভরা জীবন রয়েই যাচ্ছে তাদের। দিনশেষে  লাভবান হয় অসাধু সিন্ডিকেটধারী ব্যবসায়ীরা।

    বিসিকের তথ্য অনুযায়ী,পলিথিন প্রযুক্তির প্রতি একর জমিতে লবণ উৎপাদিত হচ্ছে ৩০ মেট্রিক টন। আর সনাতন পদ্ধতিতে উৎপাদিত হয় ১০ মেট্রিক টন। লবণ উৎপাদনের জন্য প্রথমে মাঠ পরিষ্কার ও সমতল করতে হয়, তারপর লবণ পানি জমিয়ে রাখার জন্য সেই মাঠে ছোট ছোট বাঁধ দিয়ে চার কোণায় একাধিক ঘর করতে হয়। এরপর মাঠে বিছানো হয় কালো পলিথিন, পরে বঙ্গোপসাগর কিংবা নাফ নদীর লোনা পানি ঢুকিয়ে সেই কক্ষ ভর্তি করা হয়। সূর্যের তাপে কক্ষ গুলোর পানি শুকিয়ে তৈরি হয় লবণ। পরিশেষে চাষীরা পলিথিনের ওপর থেকে সেই লবণ সংগ্রহ করে মজুত করেন। কালো পলিথিনে তাপমাত্রা বেশি বাড়ে বলেই ৯৮ শতাংশ জমিতে কালো পলিথিন বিছানো হয়, এইভাবে তীব্র রোদে কষ্ট করে ঘাম ঝড়া পরিশ্রম করে লবণ চাষ করেন চাষীরা।

    সরেজমিনে লবণ মাঠ গুলো ঘুরে দেখা যায়,সাবরাং ইউনিয়নের নয়াপাড়া, শাহপরীর দ্বীপের হাজার হাজার একর জমিতে বিশাল মাঠ জুড়ে লবণের স্তুপ। লবণ শ্রমিকরা উক্তপ্ত রোদে মাঠে কাজ করছেন, কালো পলিথিনে সারি সারি লবণের পট বা বেড, ওই বেডের পলিথিনের উপর সাদা লবণের দানা, চাষীদের ভাষায় সাদা সোনা। মাঠের শ্রমিকরা ওই বেডে খড়া লবণের পানি ছিটাচ্ছেন, শ্রমিকের শরীর বেয়ে ঝরঝর করে মাথার ঘাম পায়ে পড়ছে। তারপরেও এই তপ্ত রৌদ্রকে তোয়াক্কা না করে পুরোদমে কাজ করে যাচ্ছেন লবণ শ্রমিকরা।

    সরাসরি 'দি বাংলাদেশ টুডে'র সাথে কথা হয় শাহ পরীর দ্বীপের লবণ মাঠে আব্দুল হামিদ নামের এক লবণ শ্রমিকের সাথে, তিনি জানান, হঠাৎ করে লবণের দাম পড়ে যাওয়ায় খুবই দুশ্চিন্তায় পড়ে আছি। এক মণ লবণ বিক্রি করে ৩ কেজি চালও পাওয়া যাচ্ছে না, এভাবেই দিন দিন লবণের দাম কমে গেলে আমাদের কী উপায় হবে ! আগামীতে হুমকির মুখে পড়বে গোটা লবণ শিল্প। তিনি সরকারের কাছে ন্যায্য মূল্যের দাবি জানান। 
    শাহ পরীর দ্বীপের লবণ মাঠের মালিক জাহেদ উল্লাহর সাথেও কথা হলে তিনি দি বাংলাদেশ টুডে কে বলেন, বর্তমানে লবণের দাম প্রতি মণে ১৮০ থেকে ১৯০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এই দরের মধ্যে উঠানামা করে লবণের দাম। খরচের চেয়ে কম দামে বিক্রি করার ফলে লোকসান গুনতে হচ্ছে সাধারণ চাষীদের। 
    চাষীদের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ, লবণ মিলের মালিক ও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট তৈরী করে মাঠ পর্যায়ে লবণের দাম কমিয়ে দিয়েছে। এমনকি উৎপাদিত লবণ কম দামে বিক্রিতে এক প্রকার বাধ্য করা হচ্ছে। অথচ বাজারে এক কেজি প্যাকেট জাত লবনের মুল্য ৩০ থেকে ৪০ টাকা।
    সাবরাংয়ের লবণ চাষী মোহাম্মদ শরীফ হোসেন নিজের ভারাক্রান্ত কন্ঠে দি বাংলাদেশ টুডে কে বলেন, যেভাবে লবণের দাম দিন দিন কমে যাচ্ছে, এই অবস্থা চলতে থাকলে লবণ চাষ করে চাষীরা বিনিয়োগও ওঠাতে পারবে না, এক কথায় বলতে গেলে পানির দামেও বিক্রি করা যাচ্ছে না সাদা সোনা খ্যাত 'লবণ'। 
    তিনি আরও বলেন,প্রতি একর লবণ মাঠে খরচ পড়ছে আনুমানিক ৫০ হাজার টাকা। ইতিমধ্যে লবণ বিক্রি করে প্রতি একরে ২০ হাজার টাকাও পাওয়া যায়নি। চলমান বাজার দরে লবণ বিক্রি করা যাচ্ছে না। এমতাবস্থায় লবণ বিক্রি করলে বড় ধরণের লোকসানের সম্মুখীন হবেন চাষিরা। যার ফলে অবিক্রিত লবণের পরিমাণ ক্রমশ বেড়েই চলেছে, উৎপাদন যত বেশি হচ্ছে, লবণের দামও তত কমে যাচ্ছে যা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারের জন্য হুমকি স্বরূপ। 
    জানতে চাইলে টেকনাফ উপজেলা লবণ চাষী কল্যাণ সমিতির সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শফিক মিয়া দি বাংলাদেশ টুডে কে জানান, 'বর্তমানে লবণ মাঠ জুড়ে বড় বড় গর্তে স্তুপ করে হাজার হাজার মণ উৎপাদিত লবণ মাঠে মজুত করে রেখেছে। সিন্ডিকেট করে মধ্যত্বভোগীরা লবণের দাম কমিয়ে দেয়ায় এ অবস্থা হয়েছে কিন্তু লবণের ন্যায্যমূল্য নিয়ে কেউ ভাবছেন না এমনকি সংশ্লিষ্ট দপ্তরও না। লোকসান দিয়ে লবণ বিক্রি করে দাদনের টাকাও পরিশোধ করতে পারবে না অনেক চাষীরা।
    বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) এর টেকনাফ ইনচার্জ মোহাম্মদ মিজানুর রহমান একান্ত সাক্ষাৎকারে দি বাংলাদেশ টুডে কে বলেন,টেকনাফে লবণ চাষ হচ্ছে প্রায় ৩ হাজার ৯৪৫ একর জমিতে, ইতিমধ্যে টেকনাফ উপজেলার উপকূলীয় অঞ্চলে ৫৯ হাজার মেট্রিক টন লবণ উৎপাদিত হয়েছে, তবে গত বছরের তুলনায় লবণ উৎপাদন অনেকটা বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে লবণের দাম কম হওয়ায় চাষীদের মাঝে হতাশা দেখা গেছে, ইতোমধ্যে বিষয়টি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে আশা করছি গোটা বিষয়টি সকলের মধ্যে সমন্বয় হবে যাতে কারোরই ক্ষতি না হয়।
    প্রকাশিত: শনিবার ১৬ এপ্রিল ২০২২