• সদ্যপ্রাপ্ত সংবাদ

    রিকশার গতিতে মোটরসাইকেল চললেই কি দুর্ঘটনা কমবে!

     

    শহরের ভেতরে মোটরসাইকেলের গতি হবে সর্বোচ্চ ৩০ কিলোমিটার, মহাসড়কে যাত্রী নেওয়া যাবে না, আর উৎসবে মহাসড়কে থাকবে নিষিদ্ধ। এমন খসড়া নীতিমালা করেছে সরকার।তবে মহাসড়কে কমপক্ষে ১২৬ সিসির মোটরসাইকেল বাধ্যতামূলক করার বিধিটি ছাড়া অন্যগুলো নিয়ে ব্যাপক আপত্তি দেখা যাচ্ছে। অনেকে বলছেন, শহরের রিকশার গতিই ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটার থাকে। মোটরসাইকেলের জন্য এই গতি বেঁধে দেওয়া হাস্যকর! এ ছাড়া এতে যানজট ও দুর্ঘটনা বাড়বে। মূলত বেপরোয়া গতির কারণে দুর্ঘটনা এড়াতে ‘মোটরসাইকেল চলাচল নীতিমালা-২০২৩ ’-এর খসড়া তৈরি করেছে সরকার।পরিবহন বিভাগের যুগ্ম সচিব আনিসুর রহমানের নেতৃত্বে ৯ সদস্যের কমিটি এই নীতিমালা প্রণয়নের কাজ করেছে। খসড়া নীতিমালা নিয়ে আনিসুর রহমান সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘মোটরসাইকেলের গতি কমানোর দিকে জোর দেওয়া হয়েছে। মোটরসাইকেলে বয়স্ক ও শিশুকে যাত্রী না করার প্রস্তাব করা হয়েছে। বিএসটিআই অনুমোদিত উন্নতমানের হেলমেটসহ অন্যান্য নিরাপত্তা সরঞ্জাম চালককে পরার কথা বলা হয়েছে।’ এই যুগ্ম সচিব আরও বলেন, ‘বিষয়টি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। খসড়া চূড়ান্ত করতে অংশীজনদের সঙ্গে সভা হবে। এরপর মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রিসভার অনুমোদনের পর তা কার্যকর হবে।’ এই নীতিমালা প্রত্যাহারের দাবিতে মানববন্ধন করেছেন সাধারণ মোটরসাইকেল চালকেরা। সম্প্রতি রাজধানীর জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজা-সংলগ্ন রাস্তায় ও জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করেন তাঁরা। এই নীতিমালা নিয়ে আপত্তি জানিয়েছেন সচেতন নাগরিকেরাও। যাত্রী অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক সামসুদ্দীন চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘একটা স্বার্থান্বেষী মহলের ইন্ধনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে কালো আইন তৈরি করে যুবসমাজকে জনপ্রিয় গণতান্ত্রিক সরকারের মুখোমুখি দাঁড় করানোর চেষ্টা চালানো হচ্ছে।’দ্য ডেইলি স্টার বাংলার সম্পাদক গোলাম মুর্তোজা এক ভিডিও বক্তব্যে এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘দিনে দিনে মোটরসাইকেলের গুরুত্ব বাড়ছে। তবে সরকারের এই নীতিমালার খসড়া দেখে মনে হচ্ছে, তারা মোটরসাইকেলের ওপর বিরক্ত। মোটরসাইকেবিরোধী একটা মনোভাব নিয়ে এই নীতিমালার খসড়া করা হয়েছে।’ এই নীতিমালার খসড়া কিসের ভিত্তিতে করা হয়েছে, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি।রাজধানীসহ দেশের সর্বত্র সড়কে নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। শুধু রাজধানীর হিসাব করলেও ব্যক্তিগত গাড়ি, গণপরিবহন কোনোটিই ট্রাফিক আইন মেনে চলে না। সেটি নিয়ন্ত্রণ না করে শুধু মোটরসাইকেলকেন্দ্রিক নীতিমালা প্রণয়ন করলে কোনো সুফল আসবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।মোটরসাইকেলচালক মো. জামাল হোসেন। বাড়ি ভোলায়। থাকেন ঢাকার মোহাম্মদপুরে। মোটরসাইকেলে রাইড শেয়ার করে আয় করেন। দিনে সাত থেকে আট ঘণ্টা মোটরসাইকেল চালালে সব খরচ বাদ দিয়ে থাকে এক থেকে দেড় হাজার টাকা। এই দিয়েই চলে তাঁর ৫ সদস্যের সংসার।খসড়া এই নীতিমালা নিয়ে জামাল হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ঢাকা শহরে রিকশাও চলে ৩০ কিলোমিটার গতিতে। ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ৪০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে চলাচল করে। প্রাইভেট কার, গণপরিবহন আরও বেশি গতিতে চলাচল করে। সে অনুযায়ী ৩০ কিলোমিটার গতিতে মোটরসাইকেল চললে সড়ক দুর্ঘটনা আরও বাড়বে।’ প্রতিদিনের আয়ে টান পড়বে জানিয়ে জামাল হোসেন দাবি করেন, ‘এই নীতিমালা করা হয়েছে পুলিশকে সুবিধা দেওয়ার জন্য। আমি ৩০-এ চালাব না ৪০-এ, সেটা না দেখেই পুলিশ মামলা দেবে। আগে পুলিশের ২ হাজার টাকার মামলা থেকে বাঁচতে ৫০০ টাকা ঘুষ দিতাম। এখন আরও বেশি দিতে হবে।’এই খসড়া নীতিমালার উপযুক্ততা নিয়ে কথা হয় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) সহকারী অধ্যাপক কাজী সাইফুন নেওয়াজের সঙ্গে। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘রাস্তাভেদে যানবাহনের জন্য গতিসীমা ঠিক করা যেতে পারে। তবে নির্দিষ্ট কোনো যানবাহনের জন্য গতিসীমা ঠিক করে দেওয়ার মতো সংস্কৃতি এখনো আমাদের দেশে আসেনি। বিভিন্ন দেশে লেন বিভাজন আছে। লেন অনুযায়ী বিভিন্ন গতিতে গাড়ি চলাচল করে। তবে আমাদের এখানে লেনের সংস্কৃত নেই। সেজন্য নির্দিষ্ট একটি যানবাহনের জন্য গতি নির্দিষ্ট করা ঠিক হবে না। সেক্ষেত্রে এই নীতিমালা পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে।’একই লেনে যখন একটি নির্দিষ্ট গতির গাড়ি চলবে, আর অন্যগুলো তাদের নিজেদের গতিতে চলবে—এতে করে সড়কে যানজট ও দুর্ঘটনার প্রবণতা বাড়তে পারে বলেও মনে করেন এই সহকারী অধ্যাপক। দিনাজপুরের সাইদ আল মামুন। থাকেন বনশ্রীতে। অন্য পেশার পাশাপাশি রাইড শেয়ার করে উপার্জন করেন। এই নীতিমালা নিয়ে তিনি বলেন, ‘এটা স্রেফ অন্যান্য গাড়ির মালিকদের সুবিধা দেওয়ার জন্য করা হয়েছে। গত ঈদেও অনেক মানুষ মোটরসাইকেলে পরিবার নিয়ে বাড়িতে গেছে। তখন বাসমালিকদের ব্যবসা হয়নি। আবার এখন অনেকেই মোটরসাইকেল কেনায় গণপরিবহনের ভাড়া উঠছে না ঠিকমতো। এই মালিকদের সুবিধা দিতেই সরকার এই নীতিমালা করছে।’তবে মহাসড়কে মোটরসাইকেলের সিসি লিমিট নির্ধারণ নিয়ে সন্তুষ্ট সাইদ। তিনি বলেন, ‘এটা ঠিক আছে। বেশি সিসির মোটরসাইকেল হলে মহাসড়কে অন্য গাড়ির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা যাবে।’বুয়েটের সহকারী অধ্যাপক কাজী সাইফুন নেওয়াজ এ ব্যাপারে বলেন, ‘ডব্লিউএইচও (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা) পুরো পৃথিবীতে রিস্ক ভালনারেবল গ্রুপের মধ্যে তিনটি আর্টিকেল ইনক্লুড করেছে। এর মধ্যে একটি মোটরসাইকেল। পুরো পৃথিবীতেই মোটরসাইকেলকে ঝুঁকিপূর্ণ ধরা হয়। অনেক দেশেই মোটরসাইকেল চলাচলে সিসি লিমিট করে দেওয়া। আমাদের দেশে এমন ছিল না। তবে নীতিমালায় সিসি লিমিটের কথা বলা হয়েছে। এটাকে আমি স্বাগত জানাই। কেননা, সিসি মানেই গতি না, সিসি অনেক বেশি স্ট্যাবিলিটিও দেয়। সিসি বেশি হলে ব্রেকিং পাওয়ারও অনেক ভালো থাকে।’আরেক মোটরসাইকেল চালক নূরুন্নবী বলেন, ‘যদি মোটরসাইকেলের জন্য আলাদা লেনের ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে এই নীতিমালা কিছুটা হলেও কার্যকর হতে পারে।’বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন তানভীর ইসলাম। মিরপুর থেকে বনানী প্রতিদিন মোটরসাইকেল নিয়ে অফিস করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘প্রতিটি আইন-নীতিমালা করার আগে সরকার একটা মাঠ জরিপ করে। আমার কাছে মনে হচ্ছে সে জন্যই এই নীতিমালার খসড়ার আংশিক অংশ প্রকাশ করা হয়েছে।’৩০ কিলোমিটার গতি নির্ধারণ করে আইন প্রণয়ন করা হলে আর মোটরসাইকেলই চালাবেন না ক্ষুব্ধ তানভীর। তানভীর বলেন, ‘বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালক নিয়ন্ত্রণ না করে সবার জন্য মোটরসাইকেলের অযৌক্তিক নীতিমালা করা হচ্ছে।’মোটরসাইকেল চলাচল নীতিমালা-২০২৩ নিয়ে মোটরসাইকেল অ্যাসেমব্লার্স ও ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন সাংবাদিকদের জানিয়েছে, মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণে নীতিমালার খসড়ার আগে তাঁদের মতামত নেওয়া হয়নি। বিধিনিষেধ এলে ৯ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ ঝুঁকিতে পড়বে। ভবিষ্যতে বিদেশি বিনিয়োগ আসবে না। সংবাদকর্মী রজত কান্তি রায় বলেন, ‘প্রতিদিন রাইড শেয়ারিং মোটরসাইকেলে অফিসে আসি। গতি ৩০ কিলোমিটার নির্ধারণ করে দিলে সড়কে দুর্ঘটনা বাড়বে। যেখানে সড়কে সাধারণ গতি ৪০ কিলোমিটার, সেখানে শুধু মোটরসাইকেলে গতি ৩০ কিলোমিটার নির্ধারণ করে দিলে দুর্ঘটনা বাড়বে এটাই স্বাভাবিক।’রজত কান্তির মতে, শুধু মোটরসাইকেল চালকদের নিরাপত্তা, সড়ক দুর্ঘটনা কমানোর জন্য এই আইন করা হচ্ছে না। একটি পক্ষের স্বার্থ রক্ষা করা হচ্ছে। কারণ, ঢাকা সিটিতে যানজট বাদে একটি বাসের গতি যদি ৪৫ কিলোমিটার, একটি ব্যক্তিগত গাড়ির গতি যদি ৫০ কিলোমিটার আর সিএনজি অটোরিকশার গতি ৪০ কিলোমিটার হয় আর সেই সড়কে যদি ৩০ কিলোমিটার গতিতে মোটরসাইকেল চলে স্বাভাবিকভাবেই দুর্ঘটনার প্রবণতা বেড়ে যায়। বাড়বে যানজটও।মহাসড়কে পিলিয়ন নিয়ে মোটরসাইকেল চালানো নিয়ে কাজী সাইফুন নেওয়াজ বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয়, এই নীতিমালাটা মূলত করা হচ্ছে, হতাহতের হার নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য। একটা মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় পড়লে দুজনই আহত হয়। দুজন থাকলে দুজনই আহত হয়। সেক্ষেত্রে হতাহতের হার বেড়ে যায়।’এদিকে গতকাল সোমবার সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সভাকক্ষে এক সভায় সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘এই নীতিমালার খসড়া এখনো আমার টেবিলে আসেনি। খসড়া হলেই সেটি ফাইনাল নয়। আমি এটি দেখব। আমরা জনগণের সঙ্গে আছি। জনগণের মনের ভাষা, চোখের ভাষা আমরা বুঝি।’মোটরসাইকেল প্রস্তুতকারক, ক্রেতা-বিক্রেতা, চালক মোটদাগে এই নীতিমালার যারা অংশীজন তাঁদের কারও সঙ্গে আলাপ না করে করা এই নীতিমালা শেষ পর্যন্ত গৃহীত হয় কি না দেখার অপেক্ষা।
    প্রকাশিত বুধবার ০৮ মার্চ ২০২৩