• সর্বশেষ আপডেট

    ১৬০০ কোটি টাকা খেলাপি, জেলে বসেই আরও ঋণ নেওয়ার চেষ্টা!

      


    এক হাজার ৬'শ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে খেলাপি হয়ে আছেন তিনি। ১৭টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে। এছাড়া অন্যান্য আরও প্রায় অর্ধশত মামলাও আছে। আছে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলাও। বর্তমানে তিনি কারাগারে। কিন্তু কারাগারে বসেই স্বজনদের মাধ্যমে নতুন প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নেওয়ার ফন্দি আঁটছেন তিনি। আলোচিত এই ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতার নাম আসলাম চৌধুরী। তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক। একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থা ও আদালত সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

    বাণিজ্য নগরী চট্টগ্রামের একসময়ের আলোচিত ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠান রাইজিং গ্রুপ ও সেভেন-বি অ্যাসোসিয়েটস। এই দুই প্রতিষ্ঠানের মূল ব্যবসা ছিল পুরান জাহাজ আমদানির পর তা ভেঙে ইস্পাত হিসেবে বিক্রি করা। প্রতিষ্ঠান দুটির মালিকানায় থাকা আসলাম চৌধুরী, তার স্ত্রী জামিলা নাজনিন মাওলা, ছোট ভাই আমজাদ হোসেন চৌধুরী ও জসিম উদ্দিন চৌধুরী মিলে খেলাপি হওয়া ঋণের অর্ধেক অর্থ আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

    সূত্র জানায়, ২০০৮ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত এই দুই প্রতিষ্ঠানের নামে দশটি ব্যাংক ও সাতটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রায় ১৬০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে খেলাপি হন। এসব ঘটনায় এই দুই ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের মালিকদের বিরুদ্ধে প্রায় ৩০টি মামলা দায়ের করা হয়। এরমধ্যে দুটি মামলা দায়ের করা হয়েছিল দুর্নীতি দমন কমিশনের পক্ষ থেকে। যাতে সাউথইস্ট ব্যাংকের ১৪৯ কোটি টাকা এবং এবি ব্যাংকের প্রায় সাড়ে ৩শ’ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছিল। এছাড়া এবি ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার ৪৬৫ কোটি টাকা, সাউথইস্ট ব্যাংক হালিশহর শাখার ১৫৮ কোটি টাকা, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক পাহাড়তলী শাখার ১৫৩ কোটি টাকা, ইসলামী ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার ১০৫ কোটি টাকা, যমুনা ব্যাংক ভাটিয়ারি শাখার ৮২ কোটি টাকা, ইস্টার্ন ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার ৬৯ কোটি টাকা, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার ২০ কোটি টাকা, ব্যাংক এশিয়া ভাটিয়ারি শাখার প্রায় ৯ কোটি টাকা, সিটি ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার ৭৩ কোটি টাকা, ট্রাস্ট ব্যাংক সিডিএ শাখার প্রায় ২১ কোটি টাকা এবং পূবালী ব্যাংকের সিডিএ করপোরেট ব্রাঞ্চের ৭৪ কোটি টাকা ঋণখেলাপি রয়েছে এই চক্র।

    সূত্র জানায়, শুধু ব্যাংকই নয়, এই চক্র সাতটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকেও ঋণ নিয়ে খেলাপি হয়েছিল। এরমধ্যে লঙ্কাবাংলা ফিন্যান্সের ৪০ কোটি টাকা, আইডিএলসি’র ১৯ কোটি টাকা, আলোচিত পিকে হালদারের ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্স সার্ভিসেস লিমিটেডের ৫০ কোটি টাকাসহ ফারইস্ট ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড, প্রাইম ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফিন্যান্স কোম্পানি ও ইউনিয়ন ক্যাপিটেলের-সহ প্রায় ৪০০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ রয়েছে।

    সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং দুদকের দায়ের করা মামলায় আসলাম চৌধুরী, তার স্ত্রী জামিলা নাজনিন মাওলা, ভাই আমজাদ হোসেন চৌধুরী ও জসিম উদ্দিন চৌধুরীসহ সবাই উচ্চ আদালত থেকে শর্তসাপেক্ষে জামিন নিয়েছেন। তবে সর্বশেষ হেফাজতের দুটি মামলায় তিনি এখনও কারাবন্দি। চট্টগ্রামের বিশেষ জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর সানোয়ার আহমেদ লাভলু বলেন, আসলাম চৌধুরী ও তার ভাইদের বিরুদ্ধে দুদকের একটি মামলার বিচার কার্যক্রম চলছে। আরেকটি মামলা বিচার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার অপেক্ষায়। এই দুই মামলার আসামিদের মধ্যে আসলাম কারাবন্দি। তার দুই ভাই আমজাদ ও জসিম পলাতক। স্ত্রী জামিলা নাজনিন জামিনের মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন করেছেন।

    গোয়েন্দা সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের অভিযোগে ২০১৬ সালের মে মাসে আসলাম চৌধুরীকে গ্রেফতার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এসময় তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে একটি মামলা দায়ের করা হয়। এছাড়া তার বিরুদ্ধে ঋণখেলাপির মামলা ছাড়াও ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগসহ নানারকম অপরাধ কর্মকাণ্ডের অভিযোগে প্রায় অর্ধশত মামলা রয়েছে।

    উচ্চ আদালত ও গোয়েন্দা সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, ব্যাংকগুলোর সঙ্গে খেলাপি ঋণ পরিশোধে সেটেলমেন্ট করার শর্তে বিভিন্ন সময় হাইকোর্ট থেকে জামিন পান আসলাম ও তার পরিবারের সদস্যরা। তবে জামিন পাওয়ার পর কোনও ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ঋণ পরিশোধ করেননি তারা। উল্টো ২০১৫ সালে ঋণখেলাপির কালো তালিকাভুক্ত করায় বাংলাদেশ ব্যাংকের বিরুদ্ধেই উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন দায়ের করেছিলেন তিনি। কিন্তু পরে শুনানিতে অংশ না নেওয়ায় তারা এখনও বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণখেলাপির কালো তালিকাভুক্ত। এখন কৌশল পাল্টে অন্য স্বজনদের মাধ্যমে নতুন প্রতিষ্ঠানের নামে আরও ঋণ নেওয়ার চেষ্টা করছে এই চক্রটি।

    খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আসলাম চৌধুরী কারাবন্দি থাকলেও তার স্ত্রী জামিলা নাজনি বর্তমানে কানাডায়। তার ভাই আমজাদ চৌধুরী সিঙ্গাপুরে। যোগাযোগ করা হলে আসলাম চৌধুরীর রাজনৈতিক সহকারী মঞ্জুরুল ইসলাম জানান, আসলাম চৌধুরীর বিরুদ্ধে মোট ৭৬টি মামলা রয়েছে। এরমধ্যে ২৩টি মামলা করেছে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। আর বাকি মামলাগুলো ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগের। মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, প্রায় সব মামলাতেই আসলাম চৌধুরীর জামিন হয়েছে। দুটি মামলায় জামিন স্থগিত হয়েছে। তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলাগুলো রাজনৈতিক কারণে করা হয়েছে। আর ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মামলাগুলোতে সেটেলমেন্টের প্রক্রিয়া চলছে।

    প্রায় একই কথা বলেছেন আসলাম চৌধুরীর আইনজীবী নাসিমা আক্তার চৌধুরী। তিনি বলেন, আসলাম চৌধুরীর বিরুদ্ধে দায়ের করা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মামলাগুলোতে ঋণ রিশিডিউল করে সেটলমেন্ট করার প্রক্রিয়া চলছে।

    সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, কারাগারে বসে আসলাম চৌধুরী নিজে এবং পলাতক থেকে তার দুই ভাই, জামিনে থাকা স্ত্রী মিলে গোপনে নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামে আরও ঋণ নেওয়ার চেষ্টা করছেন। একইসঙ্গে খেলাপি মামলাগুলো নানাভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টাও করছেন। তাদের এই চক্রে কয়েকজন আইনজীবীও রয়েছেন। এভাবে ঋণের নামে বিপুল অর্থ আত্মসাৎ হতে থাকলে ব্যাংকগুলো সংকটে পড়বে, যা জাতীয় অর্থনীতির জন্য কাল হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে মনে করছেন অনেকেই।

    আর্থিক বিষয় নিয়ে কাজ করা গোয়েন্দা সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, আসলাম চৌধুরী তার আপন ভাগ্নে সরওয়ার হোসেন, ভাগ্নি জামাই মিনহাজুল হাসান এবং আমজাদ চৌধুরীর শ্যালক শহীদুল হককে দিয়ে ইতোমধ্যে ম্যাস শিপ ব্রেকিং নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। জেলে বসেই আসলাম চৌধুরী সাবেক ফারমার্স, এবি ব্যাংক ও আইএফআইসি ব্যাংক থেকে ঋণ সুবিধা গ্রহণ করে। এসব ঋণ নেওয়ার পেছনে ব্যাংকের প্রভাবশালীদের ম্যানেজ করতে বিপুল পরিমাণ ঘুষ দেওয়া-নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে। দ্বিতীয় দফায় নেওয়া ঋণগুলোও এখন মন্দ ঋণ বা খেলাপিতে পরিণত হওয়ার উপযোগী হয়েছে। গত বছর এবি ব্যাংক এনআই অ্যাক্টে নতুন করে একটি মামলাও দায়ের করেছে।

    যোগাযোগ করা হলে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন বলেন, আসলাম চৌধুরীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধে দায়ের করা মামলাগুলোর দেখভাল করছি আমরা। তিনি কয়টি মামলায় জামিন পেয়েছেন নথি না দেখে বলা যাবে না। বিষয়টি নিয়ে আমরা কাজ করছি। সূত্রঃ- বাংলা ট্রিবিউন। 



    প্রকাশিত: সোমবার ২২ নভেম্বর ২০২১