• সর্বশেষ আপডেট

    আটককৃত নারীদের সবার সাথেই মদ ও মাদকের তকমাটা কেন?

                                           

    দিগন্ত নিউজ ডেস্কঃ আসল অপরাধ ঢাকা পড়ে যাচ্ছে মদ, মাদক আর হরিণের চামড়ার নিচে। আর আমরাও সবাই হা হয়ে বসে বিভিন্ন বোতল, এর বৈশিষ্ট্য, দাম, চামড়ার ডিজাইন, আটককৃতদের সৌন্দর্য, বাড়িতে পার্টির আয়োজন ইত্যাদি বিষয় উপভোগ করছি।

    বহু বছর আগে, তা প্রায় ২৬/২৭ বছর হবে, আমাদের এক বন্ধু গল্প করেছিল, বাংলামটরের সুউচ্চ ভবনে তার বন্ধু তাকে বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিল। বলেছিল, এটা তার এক বোনের বাসা। সেখানে গিয়ে সে দেখেছিল, মা তার দুই মেয়েকে নিয়ে ঐ বাসায় বাস করে। ভদ্রমহিলা পরিপাটি, সুন্দর। ওনার স্বামী নেই। ঘর খুব চমৎকার করে সাজানো। 

    বন্ধুদ্বয় সেখানে মুরগি, সবজি দিয়ে ভাত খেয়ে ফিরে এসেছিল। পরে আর তারা সেখানে যেত, কি যেত না, তা জানি না। কিন্তু দু'দিন পরে খবর ছাপা হলো যে, ঐ ভবনের সেই ফ্ল্যাট থেকে একটি মেয়ে লাফিয়ে পড়েছে বা তাকে ফেলে দেওয়া হয়েছে। মেয়েটি নিহত হয়েছে। পরে পুলিশি অভিযানে জানা যায়, ঐ বাসায় যে নারী থাকতেন, তিনি এই দুই মেয়েকে নিজের মেয়ে সাজিয়ে রাখতেন এবং তাদের দিয়ে দেহব্যবসা চালাতেন। সেই ফ্ল্যাট থেকেও সেই আমলেও কিছু মদ পাওয়া গিয়েছিল। তবে ইয়াবা বা হেরোইন ছিল না। আর পেপারে মদসহ ঐ নারীর ছবিও ছাপা হয়নি।

    হঠাৎ করে মডেল পিয়াসা, মডেল মৌ, নায়িকা পরীমনি, নায়িকা একা, ব্যবসায়ী হেলেনা জাহাঙ্গীর, ডা. ঈশিতাকে পরপর আটকের ঘটনায় আমার সেই পুরোনো কাহিনি মনে পড়ল। তাদের বিরুদ্ধে নানারকমের অভিযোগ থাকার পরেও, কেন যেন, তাদের বাসা থেকে শুধুমাত্র বিপুল পরিমান মদ, ইয়াবসহ বিভিন্ন মাদক উদ্ধারের খবর বড় করে বারবার প্রচার করা হচ্ছে। 


    সমাজের একটা শ্রেণির এই জীবনযাপন নতুন না। বহু আগে থেকেই নারী ও পুরুষদের কেউ কেউ এইসব ব্যবসা ও এ ধরনের জীবনযাপনে অভ্যস্ত। তবে হ্যাঁ, এখন সংখ্যায় অনেক বেড়েছে। কারণ মানুষের হাতে প্রচুর অবৈধ পয়সা চলে এসেছে যে, খরচ করার জন্য নতুন ধরনের বিনোদন ইন্ডাস্ট্রি তৈরি হচ্ছে। কারও বাসা থেকে মদ ও মাদকের বোতল উদ্ধারের চেয়েও জরুরি বিষয় এখানে কারা টাকা খরচ করতে আসছে, পাবলিককে তাদের পরিচয় জানানো। অভিযুক্তদের এই বিশাল পরিমাণ সম্পদ এল কোথা থেকে এবং এই প্রক্রিয়ার সাথে কারা সম্পৃক্ত তা খুঁজে বের করা।


    পরীমনিকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাচ্ছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। ছবি: টিবিএস
    নগরীর বেশ কয়েকটি অভিজাত এলাকাসহ অন্যান্য এলাকার বড় বড় ফ্ল্যাটে বিভিন্ন পরিচয়ে এমন সব নারী-পুরুষ বাস করে, যাদের মূল ব্যবসা লোক ঠকানো, পর্ন-ব্যবসা, দেহব্যবসা এবং পার্টির আয়োজন ও মানুষকে ফাঁদে ফেলে ব্যবসা বাগিয়ে নেওয়া। নগরীর অনেক হোটেলে, ক্লাবেও এই ব্যবসা চলে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা যে এসব জানে না বা জানত না, তা ভাবার কোনো কারণে নেই। কিন্তু জনমনে প্রশ্ন জাগছে, এতগুলো মডেল, নারী উদ্যোক্তা ও ডাক্তারকে কেন একসাথে, প্রায় একইধরনের অভিযোগের জালে আটকানো হলো? 

    এই 'উচ্ছৃঙ্খল নারী'দের আস্তানায় যারা নিয়মিত গিয়ে মদ খায়, মাদক গ্রহণ করে বা নারী সংসর্গে সময় কাটায় বা ফূর্তি করে, সেই লোকগুলো কারা? জনগণ তো তাদের পরিচয়ও জানতে চায়।

    মডেল ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে নানা ধরনের কথা শোনা যায়। এখানে যে ছেলেমেয়েগুলো আসে, তারা নানাভাবে ব্যবহৃত হয়। উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ, তারকা খ্যাতি, অর্থসম্পত্তি, গ্ল্যামার সব মিলিয়ে বেশ আকর্ষণীয় জগত। পড়াশোনাও তেমন একটা লাগে না। দেহের সৌন্দর্যই সব। কাজেই মডেলিংয়ের এই ফাঁদ পাতা ভুবনে অনেকেই পা রাখে এবং ক্রমশ অন্ধকার জগতে হারিয়ে যায়। 

    এদের অনেকেই পথ হারিয়ে ফেলে। মডেল হিসেবে ফ্যাশন ইন্ড্রাস্ট্রিতে চান্স না পেলেও ধনী মানুষদের নজরে পড়ে এবং তাদের ছায়াতেই বেঁচে থাকার চেষ্টা করে। এই দেশেরই পরিচিত কিছু টাকাওয়ালা ও ক্ষমতাশালী মানুষের চাহিদার বিপরীতে এইসব মৌ-পিয়াসাদের সৃষ্টি হয়। অথচ গণমাধ্যমে বড় বড় করে মৌ-পিয়াসাদের খবর প্রকাশিত হচ্ছে; কিন্তু যাদের কারণে তাদের সৃষ্টি, তাদের কথা আসছে না, পুলিশও বলছে না।

    ঠিক এভাবেই হঠাৎ উদয় হলেন ডাক্তার ইশরাত রফিক ঈশিতা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ অন্যান্য মাধ্যমে প্রায় ৮ বছর ধরে তিনি নিজেকে কখনো তরুণ চিকিৎসাবিজ্ঞানী, কখনো-বা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হিসেবে দাবি করে আসছেন। পাশাপাশি নিজেকে মানবাধিকারকর্মী, সংগঠক, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদমর্যাদার ব্যক্তি দাবি করেও প্রতারণা করে আসছিলেন। এই দেশে যে যা খুশি দাবি করে নিজেকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করে টাকা আয় করতে পারে, ভুল চিকিৎসা দিতে পারে, এমনকি ব্রিগেডিয়ার হওয়ার মিথ্যা সনদও বের করতে পারে। এত বড় প্রতারককে যখন ধরা হয়েছে, তখন আবার সামনে এসেছে ইয়াবা ও মদ।

    একজন রাজনীতিবিদ ও নারী উদ্যোক্তা পরিচয়ে যে হেলেনা জাহাঙ্গীর এতদিন সমাজে দাপিয়ে বেরিয়েছেন, সেই নেত্রীই আজকে চার মামলার আসামি হয়ে পুলিশ রিমান্ডে রয়েছেন। এ রকম একজন ব্যক্তি, যার মোটামুটিভাবে সব রাজনীতিবিদের সাথে ছবি আছে, যিনি গণমাধ্যমে নারী উদ্যোক্তা হিসেবে এসে বক্তব্য প্রদান করেছেন, যিনি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সফরে বিদেশে গেছেন, যিনি সব রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পর্ক রেখে চলেছেন সব সময়, হঠাৎ করে কেন সেই হেলেনা জাহাঙ্গীরকে মদ, ক্যাসিনো সরঞ্জাম, বন্দুক ও হরিণের চামড়া রাখার দায়ে আটকে ফেলা হলো?

    দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী লক্ষ্য করছে, ইদানিং ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারের মাধ্যমে অনেক অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে। এক শ্রেণির অসাধু ব্যক্তি বা চক্র এই ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে প্রচারণা চালানোর মাধ্যমে নিজেকে খ্যাতিমান হিসেবে দেখিয়ে নানা রকম অবৈধ অপরাধ কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। মিথ্যাচারের মাধ্যমে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে এই প্রতারকেরা। অভিযুক্তদের অনেককে ধরার ব্যাপারে এইসব অভিযোগই যথেষ্ট ছিল। তাহলে মদ ও ইয়াবা যোগ করে কী প্রমাণের চেষ্টা করা হয়েছে?

    আমাদের দেশে মদ নিষিদ্ধ। শুধু লাইসেন্সধারীরা মদ পান করতে পারেন। অথচ দেশের অনেক ক্লাবে, রেস্তোরায় মদ বিক্রি হচ্ছে। অনেক ওয়্যারহাউস ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। তরুণদের কিশোরদের একটা বড় অংশ মাদক ব্যবহার করছে। দেশের আনাচে-কানাচে মাদকের বিস্তার ভয়াবহ। সবাইকে কি আইনের আওতায় নিয়ে আসা যাচ্ছে? 

    পরীমনির ঘটনা প্রায় মুছেই যেতে বসেছিল। এতদিন এই নায়িকাই মামলার বাদী ছিলেন, হঠাৎ হলেন অপরাধী এবং সেই মদ ও মাদক রাখার দায়ে। ডাক্তার ইশরাত রফিক ঈশিতার অপকর্ম ও প্রতারণার শেষ নাই। উনি আপদমস্তক একজন ভণ্ড। গৃহকর্মীকে নির্যাতনের অভিযোগে আটক করা হয়েছে একসময়ের চিত্রনায়িকা একাকে।

    মডেল পিয়াসা ও মৌ একটি সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্য বলে দাবি করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এরা বিভিন্ন পার্টিতে অভিজাত পরিবারের সন্তানদের ডেকে এনে কৌশলে আপত্তিকর ছবি তুলতেন। এরপর সেই ছবি দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইল করতেন। প্রশ্ন হচ্ছে, এই 'অভিজাত পরিবারের সন্তান' কারা? আভিজাত্য কি কেবল টাকায় হয়? অভিজাত পরিবারের এইসব সন্তানরা কি দুর্বল যে টার্গেট করে ফাঁদে ফেলা যায়?

    হেলেনা জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ ক্ষমতার অপব্যবহার, প্রতারণা ও লাইসেন্সবিহীন জয়যাত্রা আইপি টিভির সম্প্রচার। অথচ দেখলাম এই অভিযোগগুলোকে গৌণ করে আটককৃত নারীদের সবার সাথে মদ ও মাদকের তকমাটা জুড়ে দেওয়া হয়েছে। তাতে কি মামলা জোরদার হবে? নাকি নারীরা মদ রেখে উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করছে, এটা জনগণকে দেখানো যাবে?

    যারা অপরাধ করেছে, তারা আইনের আওতায় আসবেই। কিন্তু আমরা জানতে চাই এইসব অপরাধীদের তৈরির পেছনে কারা আছে? কারা এদের ক্ষমতাবান হতে সাহায্য করে? কারা তাদের ব্যবসা পরিচালনা করতে সহায়তা দেয়? কারা তাদের খদ্দের, কারা মাদক ও পর্ন-ব্যবসার সাথে জড়িত? যেমন করে সাততাড়াতাড়ি এদের আটক করা হয়েছে, ঠিক তেমন করে খুব দ্রুত এরা কিন্তু তৈরি হয়নি। বহুদিন ধরে, বহুজনের সাথে মিশে এরা ডালপালা মেলেছে।

    কাজেই বলতে চাই, যার যা অপরাধ সেটাকে বিচারের আওতায় নিয়ে আসুন। আসল অপরাধ ঢাকা পড়ে যাচ্ছে মদ, মাদক আর হরিণের চামড়ার নিচে। আর আমরাও সবাই হা হয়ে বসে বিভিন্ন বোতল, এর বৈশিষ্ট্য, দাম, চামড়ার ডিজাইন, আটককৃতদের সৌন্দর্য, বাড়িতে পার্টির আয়োজন ইত্যাদি বিষয় উপভোগ করছি। সঞ্জীব চৌধুরীর গানের মতো, 'সাদা ময়লা, রঙ্গিলা পালে, আউলা বাতাস খেলে, আর কাদায় ভরা মনের মধ্যে জলের সঞ্চরণ...।'

    আসল অপরাধ, অপরাধী এবং তাদের পেছনের শক্ত হাতগুলো কখনোই চিহ্নিত হয় না; আমরাও আর তাদের দেখতে পাই না। বেশ একটা ছোটগল্পের মতো ব্যাপার: 'শেষ হইয়াও হইলো না শেষ...।'

    প্রকাশিত: বুধবার ১১ আগস্ট, ২০২১