• সর্বশেষ আপডেট

    অন্যকে ফাঁসাতে থানায় বোমা মারতে বললেন এমপি শাহীন চাকলাদার

    এমপি শাহীন চাকলাদার

    যশোরের কেশবপুর থানায় বোমা মেরে এক আইনজীবীকে ফাঁসাতে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) নির্দেশনা দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে যশোর-৬ আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদারের বিরুদ্ধে। এ সংক্রান্ত একটি অডিও ক্লিপ ছড়িয়ে পড়েছে।

    জানা যায়, কেশবপুরের একটি ইটভাটার বিষয়ে অভিযোগ দাখিল করায় সাইফুল্লাহ নামে ওই আইনজীবীকে শায়েস্তা করতে এ পরামর্শ দেন শাহীন চাকলাদার। একই সঙ্গে যে কোনো ইট ভাটায় সিভিল পোশাকের পুলিশ দিয়ে বোমা হামলা চালিয়ে ডাকাতির অভিযোগে আইনজীবী সাইফুল্লাহকে মামলার আসামি করারও পরামর্শ দেন তিনি।

    এমনকি হাইকোর্টের নির্দেশনাকেও তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা হয় ওই অডিও ক্লিপে।

    অডিও ক্লিপের কথোপকথন ছিল এ রকম-

    ওসি: স্লামালাইকুম স্যার।
    শাহীন চাকলাদার: ঘুম?
    ওসি: না স্যার। ঘুমাইনি স্যার।

    শাহীন চাকলাদার: সাতবাড়িয়ার সাইফুল্লাহ কিডা?
    ওসি: সাতবাড়িয়া… সাইফুল্লাহ আছে, স্যার ওই ইটভাটার একটা বিষয় নিয়ে সাইফুল্লাহ, ‘বেলা’য় (বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবি সমিতি) যেয়ে মামলা-টামলা করে আর কী। বাজে একটা ছেলে স্যার।

    শাহীন চাকলাদার: সাইফুল্লাহ… আপনি এখন রাত্তিরে থানায় বোম মারেন একটা। মারায়ে ওর নামে মামলা করতে হইবে। পারবেন? আপনি থাকলে এগুলো করতে অইবে। না অইলে কোন জায়গায় করবেন? আমি যা বলছি, লাস্ট কথা ইডাই। যদি পারেন ওই এলাকা ঠান্ডা রাখতি, আমি বন ও পরিবেশ বিষয়ক স্থায়ী কমিটির সদস্য। ওখানে কারও বাপের ক্ষমতা নেই। বারবার যেয়ে কেন করে, আপনি কী করেন?

    ওসি: ও তো স্যার হাইকোর্টের কাগজ নিয়া আসে বারবার।
    শাহীন চাকলাদার: আরেহ… কোথার হাইকোর্ট-ফাইকোর্ট। কোর্ট-ফোর্ট যা বলুক, বলুইগ্যা। অন্য… আমাদের খেলা নাই? খেলা নাই?
    ওসি: হাইকোর্টে স্যার…
    শাহীন চাকলাদার: ওসি হলি, ওসি কিন্তু ডায়নামিক হইতে অয়। আজকে বাগারপাড়া ওসি আসছিল আমার কাছে। ওরে আবার চৌগাছায় দিয়ে দিচ্ছি। ও ওসি..চেনেন? বাগারপাড়া ওসিকে চেনেন?

    ওসি: চিনি না স্যার? মামুন সাহেবরে?
    শাহীন চাকলাদার: কথা বইলেন তার সাথে। তাকে নিয়ে আসতেছি চৌগাছায়। আপনে ওকে যে কোনোভাবে, যে কোনো লোক দিয়ে, কাইলকে যে কোনো দুর্ঘটনা ঘটায়ে কালকে কাজটা করেন, ওকে।
    ওসি: স্যার, দেখি স্যার। কী হয়েছে স্যার? ওর কি ডিস্টার্ব করতেছে আবার?
    শাহীন চাকলাদার: ও কী ডিস্টার্ব করবে? আচ্ছা, বন ও পরিবেশ অফিসে আমি আছি। কার বাপের ক্ষমতা আছে এখানে আসবে! আমি বলছি কী, একটা আপনি খেলা খেলে ওকে ভেতরে নিয়ে আসেন। কথা বুঝেন নাই?

    ওসি: স্যার, স্যার। দেখবোনে স্যার।
    শাহীন চাকলাদার: কেমন অফিসার আপনি, আল্লাই জানে। কাজ দিলি কাজ পারেন না।
    ওসি: হা হা হা হা স্যার। সব কাজই তো করি, স্যার।
    শাহীন চাকলাদার: সব কাজ করেন, না? তালিপরে যে কোনো ভাটায় যেয়ে, দরকার হলি পুলিশের দিয়ে লোক দিয়ে সিভিলে বোম ফাটায় দিয়ে চলে আসুক। বলতে হবি যে হামলা করেছে ডাকাতি করার জন্য। এটা ছিল অমুক। একটা বানাই দিলে অয়া গেল।

    ওসি: ও স্যার, ওই যে, ওই যে, বেলার যে কাগজটা আসছে, ওডা দেখছেন স্যার আপনে? হাইকোর্টের কাগজটা।
    শাহীন চাকলাদার: বেলা-ফেলা আমি দেখবোনে, আমি তো স্থায়ী কমিটির সদস্য।
    ওসি: হাইকোর্টের কাগজটা স্যার। হাইকোর্ট।
    শাহীন চাকলাদার: হাইকোর্টের কাগজে কী বলেছে?
    ওসি: রিসেন্টলি, গতকাল একটা কাগজ আসছে হাইকোর্টের থেকে স্যার।
    শাহীন চাকলাদার: কী আছে?

    ওসি: আমি দেখাবনে স্যার কালকে। কালকে সকালে হোয়াটসঅ্যাপে দিয়ে দেবোনে আপনারে, স্যার। হাইকোর্ট থেকে স্পষ্ট নির্দেশনা আসছে ওই যে, সুপার ব্রিকস বন্ধ রাখার নির্দেশ দিসে স্যার।
    শাহীন চাকলাদার: আমাদের এলাকায় স্কুল-কলেজ বাদে আমি আমার এলাকায় কোনো ব্রিকস বন্ধ করব না। যে যেই দিগ্যা। আমি করব না।
    ওসি: কাগজটা তো দেখবেন, স্যার। কী লিখছে, স্যার।
    শাহীন চাকলাদার: ঠিক আছে, ওকে।
    ওসি: আচ্ছা দেখবানে স্যার।

    এ বিষয়ে জানতে সাংসদ শাহীদ চাকলাদারের গতরাতে বলেন, এ ধরনের কথাবার্তা ওসির সঙ্গে তাঁর হয়নি। এটা কেউ টেম্পারিং করে বানিয়েছে। সাংসদ শাহীণ চাকলাদার বলেন, ‘আমি যে এলাকার সাংসদ, সেটা জামায়াত–অধ্যুষিত। এখানে কেউ এটা বানিয়েছে। এ ধরণের কোনো কথা হয়নি। ওসিও আমাকে বলেছেন, এ ধরনের কোনো কথা হয়নি।’

    এরপর সাংসদ এ প্রতিবেদককে একটি অডিও ক্লিপ পাঠান। তাতে তিনি ওসির সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া অডিও নিয়ে কথা বলেন।

    ওসি জসিমউদ্দিন বলেছেন, এই কথোপকথনের বিষয়টি তাঁর স্মরণে নেই। তিনি বলেন, নানা কারণেই সাংসদের সঙ্গে তাঁর কথা হয়। সব মনে থাকে না।

    উপজেলার উত্তর সাতবাড়িয়া গ্রামে ‘মেসার্স সুপার ব্রিকস’ নামে ইটভাটাটির অবস্থান। স্থানীয়রা বলছেন, আইনকানুন মনে এই ইটভাটাটি গড়ে ওঠেনি। ভাটাটির কার্যক্রম বন্ধের জন্যই স্থানীয় সাইফুল্লাহ আদালতে রিটটি করেন।

    সাইফুল্লাহ বলেন, তিনি ভয়ের মধ্যে আছেন। ঢাকায় বেলার কার্যালয়ে তিনি যোগাযোগ করেছেন। কী করবেন এখনো বুঝতে পারছেন না।

    ওসির সঙ্গে সাংসদের কথোপকথন প্রকাশের পর এটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। অনেকেই সাংসদের এমন কথার প্রতিবাদ জানিয়েছেন, ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। আবার অনেক রসাত্বক–মজাদার কথাও লিখেছেন। কেউ কেউ বলেন, এমন মিথ্যা মামলা এদেশের বহু মানুষের নামে আছে। যারা মিথ্যা মামলা করছে তাদের কয়েকজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে এই প্রবণতা কমবে।

    যশোর পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানালেন, অডিওর আলোচনা তাঁরা শুনেছেন। হাইকোর্টের রায় মানা হবে। এখানে অন্য কোনো প্রভাব কাজ করবে না। ওই ব্যক্তি (সাইফুল্লাহ) যিনি রিটটি করেছেন তাঁর নিরাপত্তার বিষয়টিও পুলিশ দেখভাল করবে। ওই কর্মকর্তা বলেন, কথোপকথনে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) যৌক্তিক অবস্থানই তারা প্রাথমিক ভাবে দেখতে পেয়েছেন। আরও পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হচ্ছে।

    উল্লেখ্য, যশোর-৬ (কেশবপুর) আসনের সংসদ সদস্য ও সাবেক জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ইসমাত আরা সাদেকের মৃত্যুর পর ২০২০ সালের ১৪ জুলাই যশোর-৬ আসনে উপনির্বাচন হয়। ওই উপনির্বাচনে বিজয়ী হন যশোর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার। শাহীন চাকলাদার সদর উপজেলা পরিষদের তিনবার নির্বাচিত চেয়ারম্যানও ছিলেন।



    প্রকাশিত: শনিবার, ৩০ জানুয়ারি, ২০২১