• সর্বশেষ আপডেট

    শুধু ভাস্কর্য হারাম? মাদ্রাসায় শিশু বলৎকার হারাম নয়?


    ভাস্কর্য নিয়ে ফতোয়া দেয়া হয়, শুক্রবার জুমা'র নামাজের পরে বায়তুল মোকাররম থেকে ভাস্কর্যবিরোধী মিছিল হয়, কোনোদিন তো দেখলাম না মাদ্রাসায় যারা ছাত্র ধর্ষণ করে, তাদের বিচার চেয়ে মিছিল করতে! প্রাণহীন কয়েকটা ভাস্কর্য কি ওইসব পিশাচ ধর্ষকদের চেয়েও বড় অপরাধী?


    মানুষ সহ যেকোন প্রাণীর ভাস্কর্য নির্মাণ করা হারাম- এরকম ফতোয়া দিয়েছেন দেশের পাঁচজন আলেম, সেই ফতোয়ায় আরও ৯৫ জন আলেম স্বাক্ষর করেছেন। এই ফতোয়া জারী করে তারা সরকারকে আহবান জানিয়েছেন, দেশে যেন কোন মানুষ বা প্রাণীর ভাস্কর্য নির্মাণ করা না হয়, এবং এপর্যন্ত যেসব ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়েছে, সেগুলো যেন অপসারণ করা হয়। 

    আলেমদের এই ফতোয়ার খবরটা পড়ে যেই না নিউজফিড স্ক্রল করেছি, অমনি চোখের সামনে পড়লো মাদ্রাসায় ছাত্র বলাৎকারের সংবাদ, ধর্ষক শিক্ষক গ্রেপ্তার হয়েছে পুলিশের হাতে। চট করেই মনে পড়লো, আজ পর্যন্ত কোন আলেমকে মাদ্রাসায় ছাত্র ধর্ষণ নিয়ে কোন ফতোয়া দিতে শুনিনি। ফতোয়া তো দূরের কথা, জঘন্য এই অন্যায়ের প্রতিবাদও করতে দেখিনি। বরং অনেককে বলতে শুনেছি, এগুলো নাকি ধর্মের বদনাম করার জন্য মিডিয়ার অপপ্রচার! মানে, মাদ্রাসার শিক্ষকেরা পরকালের ভয় দেখিয়ে ছাত্রকে ধর্ষণ করলে সেটা অপপ্রচার না, মিডিয়াতে খবরটা প্রকাশিত হলে তখন অপপ্রচার হয়! 



    মাসুম বাচ্চাগুলোর ওপর এই অমানবিক নির্যাতন চালানোটা কি অপরাধ নয়? এই অন্যায়ের বেলায় কেন আমাদের আলেম সমাজ মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকেন? কেন তারা সংবাদ সম্মেলন করে কখনও এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করেননি, দোষীদের বিচার চাননি? মামুনুল হক বা জুনায়েদ বাবুনগরীরা প্রাণহীন সামান্য কিছু সৌন্দর্য্যবর্ধক ভাস্কর্য দেখেই ক্ষেপে ওঠেন, ইসলামের অবমাননা হলো বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করেন, মাদ্রাসায় ছাত্র বলাৎকারের ঘটনায় তাদের ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগে না? নব্বই পার্সেন্ট মুসলমানের দেশে এমন ন্যাক্কারজনক অপরাধ কিভাবে সংঘটিত হয়- এমন প্রশ্ন তো কোন আলেমকে কখনও তুলতে শুনলাম না আজ পর্যন্ত।

    দুইদিন পরপর নতুন নতুন ইভেন্ট আসে। আজ টেন মিনিটস স্কুল বয়কট, কাল একাত্তর টিভি বয়কট তার পরদিন ভাস্কর্য বয়কট... সবই কিন্ত ওই ধর্মানুভূতিতে আঘাত হানার অজুহাতে। আমার প্রশ্ন একটাই, দিনের পর দিন, বছরের পর বছর ধরে যে মাদ্রাসায় শিক্ষক নামধারী কিছু কুলাঙ্গারের হাতে ছাত্ররা ধর্ষণ এবং যৌন নিপীড়নের শিকার হয়ে আসছেন, তখন ধর্মানূভুতিতে আঘাত লাগে না? তখন কেন কেউ বয়কটের ডাক দেয় না?


    কেন মাদ্রাসায় ছাত্র ধর্ষণের মতো গুরুত্বপূর্ণ এই ইস্যুটা নিয়ে কথা বলতে গেলে সবাই 'আরে ধর্ষণ তো স্কুল-কলেজেও হয়' বা 'এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা' বলে পাশ কাটাতে চায়? কেন কুলাঙ্গার কিছু শিক্ষকের সমালোচনা করাটাকে একদল ধর্মান্ধ লোক 'ধর্মের সমালোচনা' বলে মনে করে? এরা আসলে কাদের পিঠ বাঁচাতে চায়? ধর্ষকদের রক্ষা করার বেলায় এদের স্বার্থটা কী? শুক্রবার জুমার নামাজের পরে ভাস্কর্যবিরোধী মিছিল হয়, কোনোদিন তো দেখলাম না মাদ্রাসায় যারা ছাত্র ধর্ষণ করে, তাদের বিচার চেয়ে মিছিল করতে! প্রাণহীন কয়েকটা ভাস্কর্য কি ওইসব পিশাচ ধর্ষকদের চেয়েও বড় অপরাধী?

    মাদ্রাসায় যারা ইসলামী শিক্ষা দেয়ার নাম করে কোমলমতি শিশুদের ধর্ষণ করে, সেই নরপিশাচগুলোকে বয়কটের ডাক কেন কেউ দেয় না? টেন মিনিটস স্কুল, আয়মান সাদিক বা একাত্তর টিভি বয়কটে যত আগ্রহ দেখি, তার এক শতাংশও কেন এই অমানুষগুলোকে বয়কটের বেলায় দেখা যায় না? ভাস্কর্য নিয়ে যারা জলঘোলা করে, ছাত্র বলাৎকারের মতো জঘন্য ইস্যুতে প্রতিবাদের বেলায় কেন তাদের খুঁজে পাওয়া যায় না?



    পত্রিকা খুললেই চোখে পড়বে এমন খবর।
    যারা মাদ্রসায় ধর্ষণের ঘটনাগুলোকে 'সংখ্যায় অতি নগণ্য' ভেবে উড়িয়ে দেন, তাদের জন্য একটা পরিসংখ্যান দেই। গত সপ্তাহের শনিবার থেকে শুক্রবার, শুধু এই সাত দিনে বিভিন্ন পত্রিকায় আলাদা আলাদা অন্তত বারোটি ঘটনা প্রকাশিত হয়েছে, মাদ্রাসায় ছাত্র ধর্ষণের। করোনার কারনে অনেক মাদ্রাসা বন্ধ, তবুও সপ্তাহে বারোটি ধর্ষণের ঘটনা মিডিয়ার নজরে এসেছে। বাস্তব সংখ্যাটা আরও তিন-চারগুণ বেশি বলেই ধরে নিন। আমরা শুধু পত্রিকায় প্রকাশিত সংখ্যাটা নিয়েই কথা বলি। সপ্তাহে বারোটা, মাসে ৪৮টা, বছরে অন্তত সাড়ে ছয়শো শিশু মাদ্রাসায় বা মক্তবে পড়তে গিয়ে শিকার হচ্ছে শিক্ষক নামধারী কুলাঙ্গারদের লোলুপ লালসার। 

    প্রতিবছর শীতকালে সারাদেশে ওয়াজ মাহফিল হয়। দুনিয়াবি কত বিষয় নিয়ে সেখানে আলোচনা হতে দেখি। নারীর পোশাক থেকে হিন্দুর পূজা, নীল আর্মস্ট্রংয়ের কাল্পনিক ইসলাম গ্রহণ থেকে এন্টারকটিক মহাদেশের অস্তিত্ব- সবকিছু নিয়েই বক্তারা কথা বলেন, বলেন না শুধু মাদ্রাসায় পড়ুয়া শিশু-কিশোরদের ওপর হওয়া অবর্ণনীয় এই নির্যাতন নিয়ে। এই একটা বিষয়ে কাউকে মুখ খুলতে দেখা যায় না। না গিয়াসউদ্দীন তাহেরী, না মিজানুর রহমান আজহারী। ছাত্র ধর্ষণের ঘটনায় গ্ল্যামার নেই, নারীর পোশাকের মতো রগরগে বর্ণনা নেই, বলতে গিয়ে শরীরে জোশ আসে না, তাছাড়া অপরাধীরা সবাই পাঞ্জাবী-জোব্বা পরিহিত- তাই এদের নিয়ে কথা বলার রিস্কও কেউ নিতে চায় না! 

    এই যে এতগুলো বাচ্চাকে প্রতিদিন, প্রতি বছর মেন্টাল ট্রমার মধ্যে ঠেলে দেয়া হচ্ছে, শিশুগুলোর স্বাভাবিক মানসিক বিকাশটা নষ্ট করে দেয়া হচ্ছে, মানসিক আঘাতের মাধ্যমে তাদেরকে জম্বি বানিয়ে ফেলা হচ্ছে, আর পুরো কাজটাই করা হচ্ছে ধর্মের নাম ভাঙিয়ে, হুজুরের কথা না শুনলে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হবেন- এরকম যুক্তি দেখিয়ে। বাবা মায়েরা তাদের সন্তানদের মাদ্রাসায় বাচ্চাদের পাঠান ধর্মশিক্ষার উদ্দেশ্যে, ভাবেন ইহকাল আর পরকাল, দুই জায়গাতেই শান্তি নিশ্চিত হবে এতে। তাদের শান্তি নিশ্চিত করতে গিয়ে বাচ্চাটাকে কি ভয়ানক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে, সেটা বাবা-মায়ের কল্পনাতেও থাকে না। 


    অথচ আমাদের দেশের ইসলামিক স্কলাররা, যারা কিনা সময়ে অসময়ে অমুক-তমুককে বয়কটের ডাক দেন- তাদেরকে কখনও এই ঘটনাগুলোর সমালোচনা করতে দেখিনি। কখনও শুনিনি যে তারা মাদ্রাসায় ঘটা নিপীড়নের প্রতিবাদ করছেন। তারা কখনও বলেন না যে মাদ্রাসায় ঘটতে থাকা এরকম পাপাচার বন্ধের উদ্যোগ নিতে হবে, এমন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যেই জড়িত থাকুক, তাকে আইনের আওতায় আনতে হবে, সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। এই অপরাধীরা বুক ফুলিয়ে সমাজে দাপিয়ে বেড়ায়, কিন্তু তারা টু-শব্দটিও করেন না এদের বিরুদ্ধে। 

    আমাদের দেশটা স্বাধীন হয়েছিল ধর্মনিরপেক্ষতার শপথ নিয়ে। এই দেশে ভাস্কর্য থাকবে, মূর্তি থাকবে, থাকবে মসজিদ, মন্দির, মাদ্রাসা, সবকিছুই। ভাস্কর্য থাকলে ধর্মের কোন ক্ষতি আমি দেখি না। কিন্ত আমি যখন দেখি মাদ্রাসায় আরবি পড়ানোর নাম করে বাচ্চাদের ধর্ষণ করা হয়, হুজুর আবার এসব পাপ করার সময় ছাত্রদের আল্লাহর গজবের ভয় দেখান, অবুঝ শিশুগুলোকে ধর্মের ভয় দেখিয়ে কাবু করে রাখেন- তখন ঠিকই ইসলামের ক্ষতি হয়। অথচ সেই ক্ষতি নিয়ে কেউ কথা বলে না, এই পিশাচগুলোকে কেউ বয়কট করে না, বরং তাদের জিহাদি জোশের পুরোটাই আছড়ে পড়ে প্রাণহীন ইট-পাথরে গড়া কিছু ভাস্কর্যের গায়ে। ছাত্রকে ধর্ষণ করা মানুষ নামের ধর্ষকদের বিরুদ্ধে এই জিহাদি জোশ জাগ্রত হতে দেখা যায় না কখনও...


    প্রকাশিত: শনিবার, ০৫ ডিসেমম্বর, ২০২০