• সর্বশেষ আপডেট

    কেডিএস গ্রুপের ক্ষমতা, সাবেক কর্মকর্তাকে দিয়েছেন ২৫ মিথ্যা মামলা


    দিগন্ত ডেস্কঃ যার হাত ধরে একটি প্রতিষ্ঠান উন্নতির শিখরে উঠেছে, তার হাতেই ধরিয়ে দেওয়া হল একের পর এক ২৫টি মামলা। যে প্রতিষ্ঠানের ব্যবসার প্রসারের জন্য যিনি দিন-রাত কাটাতেন কারখানা কিংবা অফিসে, সেই প্রতিষ্ঠানেরই কর্তাব্যক্তির রোষানলে পড়ে তার দিন-রাত এখন কাটছে কারাগারের ভেতরে। এসব মামলায় যখনই তিনি জামিন পান, তখনই তার নামে দেওয়া হয় নতুন মামলা।

    কেডিএস গ্রুপের প্রতিষ্ঠান কেওয়াই স্টিল মিলের সাবেক নির্বাহী পরিচালক মুনির হোসেন খাঁন এখন কেডিএস গ্রুপের দেয়া  ২৫টি মামলায়  কারাগারে দিন কাটাচ্ছেন। শুধু মুনির হোসেন খাঁনই নয়, কেডিএস গ্রুপের এসব মামলার আসামি করা হয়েছে তার বাবা মোয়াজ্জেম হোসেন খাঁন ও তার ছোট ভাইকেও। কিন্তু তারা কখনও কেডিএসের ধারেকাছেও হাঁটেননি।

    এক সময় নির্বাহী পরিচালক মুনিরকে কেডিএস গ্রুপ পদোন্নতি দিয়ে পেইড ডিরেক্টর করেছিল তাকেই এখন তারা দিয়েছে গাড়ি চুরি সহ ২৫টি মামলা। এমনকি বিদেশি নাগরিককে খুন করে যাবজ্জীবন সাজা খাটা কেডিএস গ্রুপের চেয়ারম্যান খলিলুর রহমানের দ্বিতীয় ছেলে ইয়াসিন রহমান টিটুর হাতে জেলের ভেতরেই মুনিরকে খেতে হয়েছে কিল-ঘুষি-লাথিও।

    এভাবে কেডিএস গ্রুপের হাতে নির্যাতনের শিকার ও মামলার নেপথ্যের আদ্যোপান্ত নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছেন কারাগারে থাকা কেডিএসের সাবেক কর্মকর্তা মুনির হোসেন খাঁনের বাবা মোয়াজ্জেম হোসেন খাঁন।

     বুধবার (২৫ নভেম্বর)  চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন মোয়াজ্জেম হোসেন খাঁন।

    সাবেক এই নৌ-কর্মকর্তা বলেন, ‘কেডিএস গ্রুপের আক্রোশে পড়ে গত এক বছর ধরে বিনা বিচারে জেলে আছে আমার সন্তান মুনির হোসেন খাঁন। সে আমেরিকান পাসপোর্টধারী একজন নাগরিক। তার দাদা মুসলিম খাঁন, কলকাতা আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গ্র্যাজুয়েট। আমি মোয়াজ্জেম হোসেন খাঁন ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের তৃতীয় ব্যাচের ছাত্র এবং চট্টগ্রাম মেরিন একাডেমির দ্বিতীয় ব্যাচের ছাত্র। আমি ক্যাপ্টেন মোয়াজ্জেম হোসেন খাঁন হিসাবে সুপরিচিত। আমার ছেলে মুনির হোসেন চট্টগ্রামের সেন্ট প্লাসিডস স্কুলের ছাত্র। পরবর্তীতে ইউরোপ ও আমেরিকা থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে ব্যাংক অব আমেরিকা ফ্লোরিডায় সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসাবে ২০০৬ সাল পর্যন্তু চাকরি করে।’

    মোয়াজ্জেম হোসেন খাঁন বলেন, ‘২০০৭ সালে মুনির হোসেন তার স্কুল বন্ধু কেডিএস গ্রুপের কেওয়াই স্টিলসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম রহমানের অনুরোধে দেশে এসে কেওয়াই স্টিল মিলের নির্বাহী পরিচালক হিসাবে যোগদান করে। অল্প সময়ে কোম্পানির উন্নতির ফলে মুনির হোসেন খাঁনকে নির্বাহী পরিচালকের পদ থেকে পেইড ডাইরেক্টর করা হয়। এরপর তার রক্ত-ঘাম-মেধায় এই প্রতিষ্ঠান দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় টিন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানে (মুরগি মার্কা ঢেউটিন) পরিণত হয়।’

    মোয়াজ্জেম হোসেন খাঁন বলেন, ‘২০০৭ সালে মুনির কেডিএস গ্রুপের এই কোম্পানিতে যখন যোগ দেন, তখন এর মূলধন ছিল ৩০০ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে তা দাঁড়ায় ১৫০০ কোটি টাকায়। কোম্পানিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে মুনির হোসেনের এই সাফল্যের কথা স্টিল জগতে দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে।’

    ‘বন্ধুর অনুরোধে আমেরিকার মত উন্নত দেশের জীবনযাপন এবং উন্নত দেশে সন্তানদের লেখাপড়া এবং সন্তান-সন্ততির উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা না ভেবে বাংলাদেশে এসে তার আজকের এই পরিণতি। তার দুই সন্তান এবং স্ত্রী আজ অমানবিক জীবনযাপন করছে। সন্তানদের ভবিষ্যৎ আজ চরম অনিশ্চয়তার মুখে।

    তিনি আরও বলেন, ‘কেডিএস গ্রুপের চেয়ারম্যান খলিলুর রহমানের দ্বিতীয় ছেলে ইয়াসিন রহমান টিটু এই গ্রুপের ডিএমডি। ১৯৯৯ সালে চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ কর্মকর্তা টিএ খানের ছেলে জিবরান তায়েবীকে হত্যা করেন টিটু। এই চাঞ্চল্যকর হত্যামামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি টিটু ২০১১ সালের ১০ অক্টোবর থেকে চট্টগ্রাম কারাগারে আছেন। 

    হত্যামামলার আসামি কোম্পানি আইনে প্রতিষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্বে থাকার সুযোগ না থাকলেও টিটু বেআইনিভাবে তা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরেই প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বাকবিতণ্ডার এক পর্যায়ে অন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সামনে টিটু প্রায় এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে মারধর করেন মুনিরকে। এ সময় মুনিরকে কিল, ঘুষি, লাথিসহ চরমভাবে পেটান টিটু।’

    মোয়াজ্জেম হোসেন আরও বলেন, ‘কেডিএসের মত বড় কোম্পানির ক্ষমতার কথা মাথায় রেখে ভয়ে আমার ছেলে আর কোন প্রতিবাদ করেনি। তবে বিষয়টি উল্লেখ করে তার স্কুল বন্ধু সেলিম রহমানকে ২০১৮ সালের ১০ মে একটি ইমেইল করে। মেইলে সে পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে জানতে চায়। তার সাথে দেখা করতে চায়। কিন্তু কোনো উত্তর পায়নি। সেলিম রহমান এবং খলিলুর রহমানের সাথে বার বার দেখা করার অনুরোধ জানালেও তারা দেখা দিতে রাজি হননি।

     মেইলে আমার সন্তান তাদেরকে আরও জানিয়েছেন, তিনি সজ্ঞানে কখনো কোম্পানির স্বার্থবিরোধী কোন কাজ করেনি এবং কাউকে করতেও বলেনি। কিন্তু তারা তার সাথে কোন ধরনের কথা বলতেও রাজিও হয়নি। চিঠিতে মুনির হোসেন আরও উল্লেখ করে, সেলিম রহমানের নির্দেশেই ২০১৮ সালের ২০ জুন পদত্যাগপত্র মেইল, রেজিস্ট্রি ডাকযোগে পাঠান এবং ফোন করে দেখা করার চেষ্টা করেন। 

    ২০১৮ সালের ৪ ডিসেম্বর আরও একটি মেইল দেন। ওই মেইলেও তাদের সাথে দেখা করার আবেদন করেন। এবং তার সমস্ত পাওনা ও বকেয়া বেতনের জন্য আবেদন করেন। বার বার ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করেন। কিন্তু তারা কোন সাড়া দেননি।’

    এক বছরে মুনিরকে ২৫টি মামলার দেওয়ার তথ্য উল্লেখ করে মোয়াজ্জেম বলেন, ‘২০১৮ সালের জুন থেকে কেডিএস গ্রুপ চাকরি ছেড়ে দেওয়ার পর প্রায় দেড় বছর বেকার থাকে মুনির। এসময় তার বকেয়া পাওনা এবং বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কোম্পানির সাথে দেখা করতে চেয়েও দেখা পাননি।

     এদিকে পরিবার নিয়ে কষ্টে পড়ে যান। ইতোমধ্যে সবাই তাকে আমেরিকায় চলে গিয়ে সেখানে স্থায়ী হওয়ার পরামর্শ দেয়। কিন্তু মুনির নিজের আত্মবিশ্বাসের ওপর ভর করে অন্যত্র যোগদান করার সিদ্ধান্ত নেন। ২০১৯ সালে মুনির হোসেন আর একটি কোম্পানি অ্যাপোলো স্টিলের পরামর্শক হিসেবে যোগদান করে। কোম্পানিটি পরবর্তীতে মুনিরের নেতৃত্বে কেওয়াই স্টিলের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠে। এতে তারা আরও ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়ে। এই কোম্পানি ছেড়ে দেওয়ার জন্য নানা হুমকি দিতে থাকে। তাতে ব্যর্থ হয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের একটি অংশকে ব্যবহার করা শুরু করে কেডিএস গ্রুপ।

    তিনি বলেন, ‘প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ২০১৯ সালের ২৫ নভেম্বর চট্টগ্রামের বায়েজিদ থানায় প্রথমে একটি গাড়ি চুরির মামলা দেয় মুনিরকে। মামলায় যে সময়টা উল্লেখ করা হয়েছে সে সময় মুনির ঢাকায় আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে ছিলেন। ওই সময়ের সিসিটিভি ফুটেজ স্কুল থেকে সংগ্রহ করে আদালতে জমা দেওয়া হয়। কিন্তু এই মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এই মামলায় জামিনের জন্য উপস্থিত হলে তারা আরও দুটি ফৌজদারি মামলা দিয়ে তাকে জেলে প্রেরণ করে। সেই থেকে মুনির জেলে আছে। তার একটি মামলায় জামিন হলে তার আগেই আরেকটি মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। গাড়ি চুরির মামলায় বায়েজিদ থানা পুলিশ তাকে তিনবার রিমান্ডেও আনে।’

    তার বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের বায়েজিদ থানায় পাঁচটি, ঢাকার গুলশান থানায় একটি এবং চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে কেডিএস গ্রুপ ১৯টি মামলা করেছে জানিয়ে মোয়াজ্জেম বলেন, ‘এই মামলার মধ্যে মুনির এখন ১৯ টিতে জামিনে আছে। বায়েজিদ থানার গাড়ি চুরির মামলা ছাড়া বাকি সব মামলা প্রায় একই রকম অভিযোগ। প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে। আমার সন্তান মুনিরকে হয়রানি করার বিষয়ে ইতোমধ্যে বাংলাদেশস্থ আমেরিকান দূতাবাস তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়ে চিঠি দিয়েছে।’

    মামলায় তার বিরুদ্ধে ফ্যাক্টরির জন্য কাচামাল আমদানির সময় রপ্তানীকারক থেকে কমিশন নেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে উল্লেখ করে মোয়াজ্জেম বলেন, ‘এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা অভিযোগ। মুনিরকে ওইসব কোম্পানির এজেন্ট হিসেবে একটি কাল্পনিক চুক্তিও তারা আদালতে উপস্থাপন করছে। কিন্তু মুনিরের পিতা হিসেবে আমি ওইসব কোম্পানিতে যোগাযোগ করে জানতে পেরেছি মুনির তাদের কোনো এজেন্ট নয়। তারা যে চুক্তিপত্র দেখাচ্ছে তা ভুয়া। এ সংক্রান্ত চিঠিও বিদেশের ওইসব কোম্পানি আমার কাছে পাঠিয়েছে।’

    নিত্যনতুন মামলায় মুনিরের পাশাপাশি তাকে ও মুনিরের ছোট ভাইকে আসামি করা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি চট্টগ্রাম বন্দরের একজন সাবেক কর্মকর্তা এবং একজন ক্যাপ্টেন। বন্দর থেকে অবসর নিয়ে আমি আমার নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দাঁড় করাই। আমি আমার ছোট ছেলেকে নিয়ে আমার ব্যবসা পরিচালনা করি। মুনির স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ায় এবং উচ্চ বেতনে চাকরি করায় তাকে আমি আমার ব্যবসায় সম্পৃক্ত করিনি। তার কাছ থেকে কোনোদিন একটা টাকাও নিইনি। কারণ তার কাছ থেকে টাকা নেওয়ার প্রয়োজন আমার হয়নি। অথচ কেডিএস গ্রুপ হয়রানিমূলকভাবে আমার বড় ছেলের বিরুদ্ধে যেসব মামলা করছে, সেসব মামলায় আমাকে এবং আমার ছোট ছেলের নামও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে যুক্ত করে দিয়েছে। তারা মামলায় বলছে আমার ছেলে সিআই কয়েল (ঢেউটিনের কাঁচামাল) আমদানির সময় কমিশন নিয়েছে। মামলায় একই ধরনের অভিযোগ আমি এবং আমার ছোট সন্তানের বিরুদ্ধেও আনা হচ্ছে। অথচ কেডিএসের সাথে আমাদের কোনো ধরনের সম্পর্ক নেই। এতেই বোঝা যায়, মামলাগুলো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং হয়রানিমূলক।’

    তিনি বলেন, ‘কেডিএসের টাকা আছে। তারা টাকার বিনিময়ে প্রশাসনের একটি অংশকে ব্যবহার করে আমাদেরকে হয়রানি করছে। আমাদের পুরো পরিবার আজ বড় অসহায়।’

    তিনি তার অসহায় পরিবারকে রক্ষা করতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদনও জানিয়েছেন সংবাদ সম্মেলনে।

    প্রকাশিত: বুধবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২০